মানিক বৈরাগী

সুজনেষু পরমপ্রিয় কবিবন্ধু

মানিক বৈরাগী


সুজনেষু পরমপ্রিয় কবিবন্ধু ,,


পত্রারম্ভে সালাম শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন।এ চিঠি যখন লিখছি তখন বাংলাদেশে চলছে চরম সংকট, দেশ যেনো এক কুরুক্ষেত্র।

আপনার সাথে আমার যখন তড়িৎ সম্পর্ক তৈরি হয় দেহলিজ এর মাধ্যমে তখনও আমাদের হৃদয়জ আত্মা গড়ে উঠেনি।

আমাদের শ্রদ্ধেয় দরবেশ কবি প্রাণজি বসাক আমাদের আত্মজ সম্পর্কের অনুঘটক হিসাবে কাজ করেছেন। এটিও একটি আল্লাহর বিশেষ রাহমত।

আমরা যে নৃতাত্ত্বিকভাবে একি গোত্রভুক্ত সেটি কবি প্রাণজিদার কাছে আল্লাহ ফেরেস্তা পাঠিয়ে যেনো ফলিত রাসায়নিক বন্ধনে আবদ্ধ করেছেন।

আজ বাংলাদেশের এই চরম ক্রান্তিকালে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে, শুধু আমরা মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান হওয়ার কারণে ভাইবোন, সন্তানসন্ততিরা কেউ আর নিরাপদ নই।

এমন অনিরাপদ সময়ে আপনার একটি ভালোবাসার পত্র লিখছি।

আপনার কবিতাগ্রন্থটি পিডিএফ ডাউনলোড করে প্রিন্ট নিয়ে পড়লাম।

আপনি আমাকে দেখছেন চরম সাম্প্রদায়িক উগ্রধর্মান্ধ জঙ্গি গোষ্ঠীর আক্রমণে আমি ক্ষতবিক্ষত। সে-ই ক্ষতের দৈহিক প্রতিক্রিয়ায় প্রায় অসুস্থ থাকি।এখন একপৃষ্ঠা বই পড়লে ক্লান্ত হয়ে পড়ি।আর এই কুরুক্ষেত্রের বাংলাদেশে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকা অসুস্থ মানুষের পক্ষে কোন কিছুই লেখা অসম্ভব, অন্তত আমার পক্ষে অসম্ভব। আবার বিখ্যাত লেখকেরা পারে কারণ তারা এ পৃথিবীতে এসেছেন লেখার জন্য।

আমি আমরা পারছি না।

আমার মাঝে মাঝে মনে হয় বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এমন অকৃতজ্ঞ, কৃতঘ্ন জনগোষ্ঠীকে স্বাধীনতা এনে দিয়ে ভুল করেছেন। যার কারণে তিনি সহ তাঁর পরিবারকে শহীদ হতে হয়েছে। ভুল করেছেন ভারতমাতার সুকন্যা শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করে।ভারতের প্রায় ৩০হাজার মুক্তিসেনা ৭১এর মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে শহীদ হয়েছেন।

আমি যখন বর্তমান বেলুচিস্তানের দিকে তাকাই এখনো তাদেরকে স্বাধীনতার জন্য নিয়মিত লড়াই করতে হচ্ছে, লড়াই পুশতুনিস্তানকে,এখনো লড়াই করছে হিন্দুস্তানকে। পাকিস্তানের এসব প্রদেশের মানুষ জানে স্বাধীনতা কি বিষয় কি বস্তু।

আমাদের মুক্তি সংগ্রামে ৩০লক্ষ লোক শহীদ হয়েছেন, ৩লক্ষের অধিক নারী শিশু ইজ্জত হারিয়েছে, শহীদ হয়েছে শুধু নয় মাস মুক্তিযুদ্ধে।

স্বাধীনতার ৩বছরে আমরা আবার পাকিস্তান ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ষড়যন্ত্রে বঙ্গবন্ধুর হত্যার মধ্য দিয়ে স্বাধীন অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের পরাজয় ঘটে।

আমার এই বাংলাদেশ ভূরাজনৈতিক কারণে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির একটি চারণভূমি, এটিকে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি চারণভূমি বানাতে চায়।আর তাদের অপছন্দ অসাম্প্রদায়িক বাঙালি, বাংলাদেশ।

মাঝে মাঝে এমনও মনে হয় শেখ হাসিনা যাকে বিশ্বাস করেন, ভালোবাসেন তারাই মীর জাফরে পরিণত হয়। এ এক বিশাল আশ্চর্যজনক ট্রাজেডি।

বর্তমান বাংলাদেশে দেবী দুর্গাকন্যা শেখ হাসিনাকে হটিয়ে মহিষাসুরের শাসন চলছে। এসব আপনারা টিভি স্ক্রিনে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখছেন। কিন্তু আমরা যারা এখানে আছি ,আমরাই জানি বাংলাদেশ এখন গাজা।ফিলিস্তিনে বসে মাহমুদ দারবিশ লিখতে পেরেছেন তার লেখা, যন্ত্রণার কথা ফিলিস্তিনি পত্রিকায় প্রকাশের সুযোগ ছিলো। বর্তমান বাংলাদেশে তাও নেই।এমন এক কুরুক্ষেত্রের মধ্যে বসবাস করছি।



আপনার # আকাশচুম্বন# পড়লাম।

আপনার লেখা আকাশচুম্বন নিয়ে আমার মনে হয় আস্ত একটা বই আলোচনা গ্রন্থ লেখা যাবে।

এই খুব অল্প সময়ে আমার পক্ষে অসম্ভব। দুর্ভাগ্যজনক সত্য হলো মেরুদণ্ডের ব্যাথার কারণে টেবিলে বসে ল্যাপটপে টাইপ করবো এমন অবস্থা আর আমার নেই। বিছানায় শুয়ে শুয়ে মোবাইলে আঙ্গুল টিপে টিপেএ-ই ক্ষুদ্র পত্রপাঠ । আপনার আকাশচুম্বনে মোট ৫১টি কবিতা স্থান পেয়েছে।

বইটি যেহেতু আমি পিডিএফ প্রিন্ট করেছি খসড়া পান্ডুলিপি আকারে,বই হিসাবে যদি হিসাব করি সম্ভবত এটি প্রায় ৬ফর্মার রেগুলার সাইজের একটা বই।এখানে দীর্ঘ - নাতিদীর্ঘ কবিতা গুলোর ভাবব্যঞ্জনের পরস্পরের ধারাবাহিকতা আমাকে মুগ্ধ করেছে। কবি সম্রাট জীবনানন্দ দাশকে দীর্ঘ কবিতার পক্ষে লিখলেন এর মর্মার্থ আকাশচুম্বন এর দীর্ঘকবিতা মনোযোগ সহকারে পড়লে বুঝা যায়।

আপনার আকাশচুম্বন অধ্যয়ন করতে করতে আমার মনে পড়ে কবি বিনয় মজুমদারের কথা।আপনি যেমন ফলিত পদার্থ বিজ্ঞানের ছাত্র হিসাবে বিজ্ঞানের বাংলা পরিভাষা কে কবিতায় কিভাবে শাসন করে ভালোবেসেছেন তা চিন্তা করলেই বাংলা কবিতার মহারাজ বিনয় মজুমদারের কথা। বিনয় মজুমদার সমগ্র ভারতমাতার অনন্য সন্তান ফলিত গণিতকে কীভাবে কি অমায়িক ভাবে বিজ্ঞান কে বাংলা কবিতায় হজম করে, বাংলাভাষাকে সমৃদ্ধ করেছেন।

মাঝে মাঝে মনেহয় আপনি কবি বিনয় মজুমদারের মানসপুত্র।

আর একটি বিষয় আমার চোখে পড়লো বিজ্ঞানের বিজ্ঞানের ইংরেজি /ল্যাটিন শব্দ গুলো বাংলা শব্দের অনুবাদ না খুঁজে হুবহু ব্যবহার কী চমৎকার সামঞ্জস্য রেখে বাক্য গঠন করেছেন তা অপূর্ব।

এসব বৈজ্ঞানিক শব্দগুলোর বাংলা শব্দার্থ করলে বাংলা ভাষায় বর্ণ বেড়ে যায়,সাথে ধ্বনি প্রক্ষেপণে শ্রুতিমধুর হয় না।

তবুও এই কুরুক্ষেত্রের দেশে জীবনের চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে অপ্ল সময়ে বিস্তারিত লিখতে না পারার ব্যর্থতা আমাকে খুব খুব মানসিক ভাবে পীড়িত করছে। তবুও ভালো লাগা কয়েকটি কবিতার শিরোনাম নাম এবং কিছু উজ্জ্বল পঙতি উল্লেখ না করে পারছি না।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী কলকাতার মহামারিতে বসে সব দুর্বিষহ একপাশে ঠেলে দিয়ে নির্মোহ ভাবে কবিতাকে ধারণ ক্ষমতা জীবনানন্দের ছিলো।

আমার দৈহিক মানসিক শক্তি তেমন না, আমি খুব স্নায়ু অনুভূতি তাড়িত রাজনৈতিক সাহিত্য কর্মী।বাংলাদেশের বর্তমানে এমন অবস্থা বিরাজ করছে

আপনি মনস্থির করলেন আজ একটি বই পাঠ শেষ করবেন এবং পাঠ প্রতিক্রিয়া লিখবেন,কিন্তু ঘন্টাখানেক পরে শুনলেন অমুক বাজার বা পাড়া সাম্প্রদায়িক শক্তি জ্বালিয়ে দিয়েছে। আমি তো সমাজবদ্ধ মানুষ, সমাজের এহেন অবস্থায় আমার মন খারাপ হয়ে পাঠবিঘ্ন ঘটে,ক্লান্ত হয়ে পড়ি হতাশায়।

এহেন অবস্থায় আকাশচুম্বন থেকে কিছু পঙতি


হাইওয়ে
যেভাবে একের পর একটা মাইলস্টোন আসে
গতিবেগকে পিছনে ফেলে আগে বেড়ে যায় হাইওয়ে,
প্রত্যেকটি পথ তাই আরও পঞ্চাশটি অন্ধকারের গন্তব্যের রকমফের
প্রত্যেকটি অন্ধকারকে আরও ঘন করে তোলে
এক একটি জঙ্গল

#

বিভিন্ন গন্তব্যের দিকে
বেঁকে আসা গ্লসি ব্লাড ছবিগুলি বিপরীত
রাইট অ্যাঙ্গেলে ক্রমাগত সরে যায়
কথা দেবার আগে,

#

হাইওয়ে কে দাঁড় করিয়ে নিজে কে প্রশ্ন করি
ঠিক কতটা গভীর ঘুম পেলে
এখানেই থেমে যাওয়া যায়।

#

শুধু হাটতে হবে বলে আবিষ্কার হয়েছিল এই পথ
কিংবা আমাদের পথ করে নিতে হয়েছিল গাছপালা কেটে
নিশ্চুপ ঘুমের অজুহাতে

#

ক্রমাগত মুখের উপর উঠে আসে নতুন জনপদ
আমার ভিটে বাড়িকে দেয়া অঙ্গিকারগুলো,
খাদ্যের তাড়না এড়িয়ে এগিয়ে যায় মাইলফলক

#

স্পিড ব্রেকার
যাত্রা পথের কাছে আমার এই একমাত্র প্রার্থনা -
হে কুলনারীগণ,
এহেন অনাবৃত পিঠের ভাঁজে ব্লাউজকে আর রক্তাক্ত কোরো না
আমার পায়ের নীচে মাটি সরে যায়

#

দিন

বেড়ে উঠার দিনে রোজকারের প্রশ্ন
রাত থেকে রাত
হরমোন ফিরে আসে না
রোমান্সের গতিবেগে কৈশোরের কেটে যাওয়া বাই - সাইকেল জার্নি

#

ঘড়ির উপর থেকে ভারটা রাখতেই
দিনগুলো হ্যাঁচকা টানে
হাত বের হয়ে যায়!

#

জল জ্বলে ওঠে
এইসব শিল্প -ব্যস্ততা
এত কার্বনের ভিড়,এত সালফার, এত সীসা
এর থেকে বীজ ছেনে নিয়ে জরায়ুতে নিষেক করতে হয়
আমি জন্মের কী বুঝি
এই গ্রীষ্মে আরাবল্লীর উপর এক গোছা মালতী ফোটাতে হলে
কতটা সরু করে তুলতে হয় পেন্সিলের শিশ।

#

পরস্পর পরম্পরা কয়েকটি কবিতা আমার অসাধারণ লেগেছে প্রিয় কবি।

যেমন ১- খোঁচা ২- মিসলেনিয়াস

আবার দীর্ঘকবিতার মধ্যে পরম্পরা সিরিজ যেমন

প্রেম। আপনি প্রেম প্রেম বর্তমান, অধুনা-আধুনিক, প্রাগৈতিহাসিক থেকে বুর্জোয়া পুজির উম্মাদনায় প্রযুক্তির ভেতর দিয়ে প্রেম আবিষ্কার করেছেন।

#

আপনার দীর্ঘকবিতা # স্টাচু# কবিতা আমার মনে হয় একটি পরিক্ষণ - নীরিক্ষণের মধ্যদিয়ে চমৎকার অভিষেক।

প্রিয় হৃদিজ কবি পীযুষ এই কাব্যপত্র আজ এতোটুকুতে ইতি টানছি।

কারণ আমাদের নিরাপদ শিক্ষার্থী দুই সন্তান জেল থেকে মুক্তি পেয়েছে।

তাদের কাছে ফিরতে হবে আমার। এই উগ্রসাম্প্রদায়িক শক্তি সবসময় অসাম্প্রদায়িক মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের টার্গেট। সমগ্র বিশ্বে মানুষের পক্ষে প্রগতির লড়াই যখন হাজার বছর ধরে চলমান। আমরা তারই অংশ।এ বুঝ টুকু আমার সন্তানের কাছে পৌঁছাতে হবে। বাংলাদেশের কুরুক্ষেত্রের দক্ষিণ পূর্বপ্রান্ত থেকে দোয়া করি আপনি আপনারা ভালো থাকুন কবিতার জয় যাত্রা অব্যাহত থাকুক। দরবেশ কবি প্রাণজিদা আবারও সালাম। ভালো লাগে আমার প্রিয় শ্রদ্ধেয় প্রৌঢ় শিশু প্রাণবন্ত প্রণবদাকে।তাঁকে আমার সালাম শুভেচ্ছা দিবেন।

আল্লাহ আপনাদের মঙ্গল করুক, আমিন।


ইতি

মানিক বৈরাগী,

কক্সবাজার, বাংলাদেশ।