প্রশান্ত বারিক
আমার অনুজপ্রতিম কবি পীযূষ বিশ্বাস
প্রশান্ত বারিক
প্রায় তিন দশকের বেশি সময় ধরে দিল্লির রুক্ষ মাটিতে আমি বাংলা কবিতার চাষ করে চলেছি, মূলত পোস্ট-মডার্ন ধারায়। দিল্লির সাহিত্যিক পরিমণ্ডলে কত মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে, কত অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি! 'দিল্লি হাটার্স' গ্রুপের সেই দিনগুলো, কত গদ্য, আলোচনা আর কবিতার জন্ম হয়েছে এই শহরের বুকে। সেই পথচলাতেই আমার সঙ্গে পরিচয় ঘটে এক তরুণ কবির – পীযূষকান্তি বিশ্বাস। অত্যন্ত উঁচু মানের কবি সে, আমার অনুজপ্রতিম। তাকে নিয়ে আমি গর্ব করি। আমার মনে হয়, এই সময়ের দিল্লি অঞ্চলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চার যে আন্দোলন বা প্রবাহ, পীযূষ তার অন্যতম পথিকৃৎ।
আজ যখন তার সম্পর্কে কিছু লেখার কথা ভাবছি, তখন মনে পড়ছে কত স্মৃতি, কত কথা। এই লেখার কাঠামো হয়তো আমার স্বভাবসিদ্ধ পোস্ট-মডার্ন ঢঙেই এগোবে, যেখানে বর্তমানের বাস্তবতার সঙ্গে মিশে যাবে অতীতের ছায়া, ব্যক্তিগত অনুভূতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকবে বৃহত্তর প্রেক্ষাপট।
দিল্লি, এক ঐতিহাসিক শহর, যার বুকে লেগে আছে কত রক্ত, কত ঘাম, কত সৃষ্টির উল্লাস আর ধ্বংসের দীর্ঘশ্বাস। প্রাগৈতিহাসিক খাণ্ডবপ্রস্থ থেকে আজকের কংক্রিটের জঙ্গল – এই শহরের সমাধিফলকে খোদাই করা আছে লুন্ঠন, হত্যা, ধর্ষণ আর ধর্মান্ধতার অভিশাপ। এই শহরেই দেখেছি কত মর্মান্তিক ঘটনা – গীতা-সঞ্জয় চোপড়ার নৃশংস হত্যাকাণ্ড, ইন্দিরা গান্ধীর হত্যা ও তার পরবর্তী শিখ নিধন যজ্ঞ, চিত্তরঞ্জন পার্কের উত্থান, পথনাটিকা করতে গিয়ে সফদর হাশমির প্রাণদান। দেখেছি দরিয়াগঞ্জের ভিড়ে কবি লোকনাথ ভট্টাচার্যের আর্তনাদ, দেখেছি কবি গালিবের বিষণ্ণ পদচারণা, দেখেছি বাহাদুর শাহ জাফরের নির্বাসন। এই রক্তাক্ত, ছিন্নভিন্ন, বারুদপোড়া দিল্লির গর্ভেই জন্ম নিয়েছে আবার কত শত কবি, লেখক, শিল্পী – যারা এই শহরের যন্ত্রণা আর সৃষ্টিশীলতাকে ধারণ করে চলেছেন।
আমার সাহিত্য জীবনের সেই আদি পর্বে, সত্তরের দশকের শেষ বা আশির দশকের শুরুতে, দিল্লির বুকে বাংলা সাহিত্যচর্চা ছিল এক অন্যরকম সংগ্রাম। তখন আজকের মতো এত সুযোগ, এত মাধ্যম ছিল না। সেই সময়েই আমাদের কয়েকজন তরুণের হাত ধরে জন্ম নিয়েছিল 'জিরো আওয়ার' (Zero Hour) – এক আগ্নেয় স্ফুলিঙ্গ। আমার দীর্ঘ কর্মজীবনের আদি স্থান, ডিফেন্স কলোনির ফ্লাইওভারের নিচে 'মোড় রিসার্চ প্রাইভেট লিমিটেড' নামে এক ছোট মার্কেট রিসার্চ কোম্পানির ভাড়ায় নেওয়া অফিসটিই ছিল এর আঁতুড় ঘর। প্রতাপ দাশগুপ্ত, অরূপ চৌধুরী, আমি (প্রশান্ত বারিক) আর দীপঙ্কর দত্ত – আমাদের চারজনের চাঁদায়, পিন্টুদার প্রেস থেকে ছাপা হয়েছিল বাংলা হরফে মাত্র দুটি সংখ্যার প্রচ্ছদবিহীন পত্রিকা। পরে দীপঙ্করের সম্পাদনায় ইংরেজি 'জিরো আওয়ার' প্রকাশ করি – কখনও জেরক্স করে, কখনও অফিসের সাইক্লোস্টাইল মেশিনে। সেই সময়কার কষ্ট, সেই লড়াই, মুম্বাইতে মলয় রায়চৌধুরীকে পত্রিকা পাঠানো – সে এক দীর্ঘ ইতিহাস।
এই দীর্ঘ পরিক্রমায় আমি কত মহীরুহের সান্নিধ্যে এসেছি! শ্রদ্ধেয় সমীরণ মজুমদার (অমৃতলোক), শশাঙ্ক শেখর মুখোপাধ্যায় (সকল বিভাগ), ধ্রুবচন্দ্র হালদার (পত্রিকা), শিবনারায়ণ রায় (জিজ্ঞাসা), বিবেকানন্দ রায় (সাপ্তাহিক সমাচার), মীরর রায়চৌধুরী (কৃত্তিবাস), অরুণ চক্রবর্তী (প্রাণান্ত বহিরঙ্গ), দিলীপ পোদ্দার ও কবি প্রাণজি বসাক (দিল্লি হাটার্স, অবরোধবাসিনী), শিল্পী-নাট্যকার-সাহিত্যিক তড়িৎ মিত্র, চিত্রশিল্পী-কবি-গল্পকার হিমাদ্রি দত্ত, আর আমার দীর্ঘ পথের সহযাত্রী, হঠাৎই মহাশূন্যে ছিটকে যাওয়া অকালপ্রয়াত বন্ধু কবি দীপঙ্কর দত্ত – এই সব মহান মানুষগুলোর মতোই কবি পীযূষ বিশ্বাসও কখন যে আমার চেতনায়, আমার ভাবনায় একাকার হয়ে গেছে, আমি হয়তো টেরই পাইনি।
পীযূষের মধ্যে আমি সেই একই সারল্য , বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও মানুষের জন্য নিজের জীবনকে বাজি রেখে এগিয়ে যাওয়ার সেই একই জেদ দেখতে পাই, যা দেখেছিলাম ক্ষণজন্মা দীপঙ্কর দত্ত বা কবি প্রাণজি বসাকের মধ্যে, বা যা আজও দেখি শ্রদ্ধেয় সমীরণ মজুমদারের মধ্যে। তাদের মতোই পীযূষও আমার দেহ-মনের রসায়নে মিশে গেছে।
কবি পীযূষ বিশ্বাসের সাহিত্যকর্মের চুলচেরা বিশ্লেষণ করার ধৃষ্টতা বা মুন্সিয়ানা আমার নেই। তার জন্য অনেক বিদগ্ধ সমালোচক ও একাডেমিক বিশ্লেষক রয়েছেন। আমি এখানে শুধু আমার ব্যক্তিগত অনুভূতি আর অভিজ্ঞতার কথাই বলতে পারি।
তার কবি প্রতিভার পাশাপাশি আমাকে যা মুগ্ধ করেছে, তা হলো প্রযুক্তি ও সাহিত্যের মেলবন্ধনে তার অসামান্য দক্ষতা। একবার তার মহাবীর এনক্লেভের ফ্ল্যাটে বসে আমি চাক্ষুষ করেছিলাম এক অত্যাশ্চর্য ঘটনা। ল্যাপটপের মেমোরিতে কিছু পছন্দের শব্দ ইনপুট দিয়ে নির্দিষ্ট ফল চাইতেই পর্দায় হামাগুড়ি দিয়ে উঠে এল এক জলজ্যান্ত কবিতা! প্রযুক্তির এই বুদ্ধিমত্তার ভেলকি দেখে আমি সেদিন সত্যিই অবাক হয়েছিলাম। পরবর্তীকালে এই বিষয়ে আমি একটি দীর্ঘ বিশ্লেষণাত্মক প্রবন্ধ লিখেছিলাম, যা শ্রদ্ধেয় কবি অজয় বসু ও বিশ্বরূপ দে সরকার সম্পাদিত 'মধ্যবর্তী' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। পীযূষের এই প্রযুক্তিজ্ঞান যে কেবল ব্যক্তিগত নিরীক্ষায় সীমাবদ্ধ নয়, তা আমরা দেখেছি 'শূন্যকালে'র আধুনিক উপস্থাপনায় এবং বর্তমানে 'দেহলিজ' পত্রিকার সাবলীল পরিচালনায়। অতীতের 'জিরো আওয়ার'-এর সেই স্পর্ধাকে দীপঙ্কর যেভাবে ছবি আর লেখার মিশেলে অনন্য করে তুলেছিল, পীযূষও সেই ধারাকেই বহন করে চলেছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায়। 'দেহলিজ'-এর সাম্প্রতিক 'দ্রোহ' সংখ্যাটি (আর জি কর হাসপাতালের ঘটনার প্রতিবাদে প্রকাশিত) বা তারও আগে প্রকাশিত বিভিন্ন স্মরণীয় সংখ্যাগুলি এর প্রমাণ।
পীযূষের আরও একটি বড় গুণ হলো তার চুম্বকীয় ক্ষমতা – বিভিন্ন প্রান্তের গুণীজনকে সে সহজেই কাছে টেনে আনতে পারে, একই মঞ্চে পাশাপাশি বসাতে পারে। দিল্লির সাহিত্য জগতে এই সংযোগ ঘটানো, সকলকে একসঙ্গে নিয়ে চলার প্রয়াস অত্যন্ত জরুরি, আর পীযূষ সেই কাজটি নিপুণভাবে করে চলেছে।
তবে মাঝে মাঝে চিন্তা হয়। যখন দূর থেকে ফোনে তার ক্লান্ত স্বর শুনি, যখন বলে – "রাত জেগে কাজ করি দাদা, ঠিকমতো ঘুমাতে পাই না, সামনে রাখা গ্লাসের জলটুকু খাওয়ার কথাও মনে থাকে না" – তখন কষ্ট হয়। এই প্রবল টানাপোড়েনের মধ্যেও, পল্লী মায়ের কোল থেকে ছিটকে এসে এই প্রাগৈতিহাসিক দিল্লির তীব্র শীত (-৩°) আর অসহনীয় গরমকে (৪৮°) উপেক্ষা করে, বুকে অদম্য জেদ আর ভালোবাসা নিয়ে তার এই সাহিত্য যাপন, তার এই শিল্পিত বেঁচে থাকা – এক কথায় অনবদ্য।
পীযূষ বিশ্বাস দিল্লির বর্তমান বাংলা সাহিত্যের এক বৃহৎ কাণ্ড, যার ডালপালা ক্রমশ বিস্তার লাভ করছে। তার শিকড় হয়তো সত্তরের দশকের সেই উত্তাল সময় থেকে রস আহরণ করেছে, যা দূর বঙ্গভূমি ও অন্যান্য ভূখণ্ডে ছড়িয়ে পড়েছিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়দের হাত ধরে। সেই ঢেউয়েরই উত্তরসূরী আজকের পীযূষ, প্রাণজি বসাক এবং আরও অনেকে।
উপসংহার টানার আগে এটুকুই বলব, অতীতের সেই 'জিরো আওয়ার' থেকে আজকের 'দেহলিজ' – দিল্লির বাংলা সাহিত্যের যে নিরন্তর প্রবাহ, পীযূষ বিশ্বাস সেই প্রবাহের এক অবিচ্ছেদ্য ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আমার অনুজপ্রতিম এই কবির জন্য রইল আমার আন্তরিক স্নেহ, ভালোবাসা ও শুভকামনা। তার পথচলা আরও মসৃণ হোক, তার সৃষ্টি বাংলা সাহিত্যকে আরও সমৃদ্ধ করুক।
Tags:
ক্রোড়পত্র