প্রণব দত্ত

দৃঢ় বিশ্বাস আর উদ্ভাসিত সমাজ

প্রণব দত্ত



এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে প্রায় সব মানুষের মধ্যেই কোনো না কোনো শৈল্পিক গুণ এবং সৃজনশীলতা থাকে এবং সেই গুণ অনেকের মধ্যে জন্মগত, কারো মধ্যে জিনগত আবার কারো কারো মধ্যে ঈশ্বর প্রদত্ত। এটা ধরে নেওয়া যায় যে, সমস্ত মানুষ তাদের মধ্যে সন্নিহিত গুণাবলী উপরি উক্ত উপায়ে আহরণ করে। সেটা একটা দিক। কিন্তু এইভাবে সংগৃহীত গুণাবলী ছাড়াও মানুষের মধ্যে কিছু কিছু এমন গুণ আমরা লক্ষ্য করতে পারি যেগুলো সেই ব্যক্তি তাঁর দক্ষতা দিয়ে, তাঁর কর্ম ক্ষমতা দিয়ে এবং তাঁর অধ্যাবসায়ের মাধ্যমে অর্জন করে।

ভিডিওটির  ভাষ্য শোনার জন্য ক্লিক করুন । 





আজকের নিবন্ধের বিষয় এমনই এক ব্যক্তিত্ব। আলোচনার ক্রমান্বয়ে ক্রমশঃ প্রকাশ্য। “দিল্লি প্রবাস দেখতে দেখতে কম হয় নি” বলে দাবি করেন “লোকটি”। কমবেশি বুঝি না তবে এমন অনেককে তো দেখেছি যাঁরা প্রায় অর্ধশতাব্দী কাটিয়েও সেভাবে আপন করে নিতে পারেনি এই ইঁট-কাঠ পাথরের কাঠিন্যকে। আমাকেই দেখুন এতকাল পরেও সবসময় এক পা বাড়িয়েই রেখেছি যেন সুযোগ পেলেই দৌড়ে বেরিয়ে যাব। আর একটা দাবি প্রায়ই শুনে থাকি তাঁর মুখে বাংলার জন্য কিছু করার, বাংলা ভাষার জন্য, বাংলা সাহিত্যের জন্য সর্বোপরি বাংলা কবিতার জন্য কিছু একটা করার কথা। বিভিন্ন জনের মুখে এই কথাটাতো আজ থেকে শুনছি না; ভিন্ন ভিন্ন সংগঠন, প্রতিষ্ঠান, সংঘ এমনকি ক্ষমতাসীন বড় বড় ব্যক্তি বিশেষের মুখেও সাড়ম্বরে গুরুগম্ভীর কন্ঠে বার বার শুনেছি। ফলাফল তথৈ বচ। কেবল শুন্যগর্ভ আস্ফালন। পরিণামলক্ষনীয়ভাবে এতগুলো বাংলা স্কুল এখনও এই শহরে থাকা সত্বেও বাংলা পড়ুয়াদের সংখ্যা কমতে কমতে তলানীতে ঠেকেছে প্রায়।

তবে তাঁর মুখে এই “কিছু একটা করতে হবে” এই উক্তিটির মধ্যে একটা অন্য রকম আর্তি, একটা অন্য রকম আঁকুতি, একটা অন্য রকম দৃঢ়তা আমি বারবার লক্ষ্য করেছি বরাবর।

“ভদ্র লোকের” সঙ্গে আমার পরিচয় খুব বেশি দিনের নয়, আমাদের দুজনেরই পরিচিত একবন্ধু অর্থাৎ কমোন ফ্রেন্ডের মাধ্যমে, সেও এক উল্লেখ করার মত ঘটনা। আমি সরকারী আবাস ছেড়ে সবে সবে উঠে এসেছি এই পাড়ায়, পরিচিত বন্ধুবান্ধব থাকলেও অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ হয়ে ওঠেনি। প্রাণজিদা মানে কবি প্রাণজি বসাক একদিন বৈকালিক আড্ডার আগে বললেন একজনকে ডাকি! প্রাণজিদার সঙ্গে এক সাহিত্য আসরে প্রথম পরিচয়ের পর ততোদিনে আমাদের সম্পর্ক অনেকটাই দানা বাঁধতে শুরু করেছে। একসঙ্গে প্রাতঃ ভ্রমণ সেরে ফেরার পথে ভোরের বাজার থেকে মাঝে মধ্যে ফার্ম ফ্রেশ টাটকা সব্জি কেনা তারপর একসঙ্গে চা খাওয়া এ সবের সূত্র ধরেই সম্পর্ক এগিয়ে চলছিল।সন্ধ্যায় আমরা কখনও সখনও বসতাম অন্নপূর্ণার গলিটা মেইনরোডে যেখানে শেষ হচ্ছে তার বাঁদিকের জুতোর দোকানের সিঁড়িতে। যথারীতি আমরা সেদিনও জুতোর দোকানের সিঁড়িতে বসেছি। প্রাণজিদার ডাকে সাড়া দিয়ে অল্পক্ষণের মধ্যেই এলেন মাঝবয়সী এক তরুণ। প্রাথমিক আনুষ্ঠানিক পরিচয় পর্ব সম্পূর্ণ হল। এর আগেও প্রাণজিদার মুখে তাঁর নাম শুনেছি। কবিতার কথা উঠলে স্বাভাবিকভাবেই অনায়াসে “তাঁর”প্রসঙ্গ এসে যেত। প্রাথমিক পরিচয়ে নাম ধাম পেশা ইত্যাদি এবং সাহিত্য বিশেষ করে তাঁর কবিতা অনুরাগের কথা জানা গেল। কর্মজীবনের প্রথম দিকটায় উনি বিমানবাহিনীতে ছিলেন এই বিষয়টিতে আমি কিছুটা আগ্রহী হলাম কারণ আমার বড়দা বিমানবাহিনীতে ছিলেন কিনা। পয়ষট্টি এবং একাত্তরের লড়াইয়ে সক্রিয় অংশগ্রহণের রোমহর্ষক কাহিনী বড়দার মুখে শুনে শুনে সসস্ত্র বাহিনীতে কাজ করা লোকেদের মধ্যে আমি একজন দেশপ্রেমিককে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করি।

এরপর থেকে মাঝে মধ্যে আমরা আড্ডায় মিলিত হতে থাকি, কখনও রাস্তার পাশের চায়ের দোকানে, কখনও নতুন খোলা রিফুয়েল ক্যাফে, কখনও টিনটিন আবার কখনও মেইন রোডের ওপরে সদ্য চালু হওয়া রুফ টপ কফি ক্যাফেতে। আলোচনার বিষয় মুলতঃ কবিতাই থাকে। কর্পোরেট সেক্টরে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার জগতে বেশ বড়সড় পদে কাজ করেন “তিনি” এক কথায় টেকনোক্র্যাট, স্বভাবতই কাজের দিনে সময় বের করা কষ্টসাধ্য, কিন্তু একটা জিনিস আমি বরাবরই লক্ষ্য করেছি, দিনান্তে একবার আমাদের ত্রয়ীর সাক্ষাতের অপেক্ষায় থাকতেন তিনি। এটা বলাই বাহুল্য যে আমরাও উপভোগ করতাম এই সঙ্গ এবং সর্বোপরি আলোচনা। ক্রমশঃ আমরা হয়ে উঠেছি পিথ্রি অর্থাৎ প্রাণজি-প্রণব এবং “আর এক পি”।ঘটা করে সমাজ মাধ্যমে ঠাঁই পেয়েছে পিথ্রি নামাংকিত একটি হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপ। অভিন্ন যোগাযোগের পথ প্রযুক্তির প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে প্রশস্ত হয়েছে।

কথা বলার সময় স্বভাবজাতভাবেই আমরা মানে কন্ঠ বা বাচিকশিল্পীরা লক্ষ্য রাখি উচ্চারণের বিশুদ্ধতা, কন্ঠের ওঠানামা, স্বর স্থাপন, স্বর প্রক্ষেপণ, শব্দ চয়ন অলংকার ইত্যাদির প্রতি। দীর্ঘ সময়ের রেডিওর প্রেক্ষাপটের প্রভাবে আমার ক্ষেত্রে এমনকি স্বাভাবিক আলোচনার ক্ষেত্রেও তার প্রতিফলন নাকি ধরা পড়ে । অন্যদিকে কবিরা যখন কবিতার কথা বলেন তখন রূপকল্প, চিত্রকল্প, বিমূর্ত, মূর্ত, ছন্দ, অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত, সঙ্গীত, রূপক, উপমা, দ্যোতনা ইত্যাদি শব্দগুলো উচ্চারিত হয়। এটা নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে যে কবিতা লেখার ক্ষেত্রে নিয়মিততা রক্ষা করেন তিনি। এমন কি চায়ের দোকানে বসেও কবিতা পাঠ, তার চাইতেও বড় কথা হল কবিতার বিষয় নিয়ে, ভাষা নিয়ে গঠন নিয়ে এবং বহু চর্চিত কবিতার দুর্বোধ্যতা নিয়ে আমাদের যত কথা হয় তাতে তাঁর অংশ গ্রহণ সব চেয়ে বেশি। এথেকে কবিতার প্রতি তাঁর অনুরাগ, একনিষ্ঠতা এবং পুরোপুরি সমর্পন সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ কোথাও থাকে না। আমি নিজে যেহেতু কবিতা ভালবাসি, তাই কবিতা ভালবাসার এই মানুষকে আমি ভালোবেসে ফেলি। তার মানে এটা নয় যে মতাদর্শগত এবং ভাবাদর্শগত দিক থেকে আমাদের মধ্যে মত পার্থক্য নেই, আছে এবং কখনও কখনও সেটি সদম্ভে প্রকাশ পায়। কিন্তু তার সীমানা ছাড়ায় না কখনও একেই বলে পারস্পরিক শ্রদ্ধা।

এই শ্রদ্ধা ও ভালোবাসাকে সম্বল করে পিথ্রির সেবারের বাংলাদেশে সাহিত্যসফর চিরস্মরণীয় হয়ে থাকার কথা। বাংলাদেশের কবি ইউসুফ মুহম্মদের আমন্ত্রণে চট্টগ্রামে তিন দিন ধরে কবিতা পাঠ, সে দেশের কবিবন্ধু মানিক বৈরাগীর সহযোগিতায় কক্সবাজার ও রামু উপজেলায় আমাদের জন্য বিশেষ সাহিত্য আসরের আয়োজন ও সম্বর্ধনা জ্ঞাপন এবং ঢাকার কবি আশরফ জুয়েলের আতিথেয়তায় ঢাকায় আয়োজিত বিশেষ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ। প্রাণজিদা পথ প্রদর্শক হলেও এই সব কিছুই সম্ভব হয়েছিল এই “আর এক পি”র সৌজন্যে।

প্রাণজি বসাক/গৌতম দাশগুপ্তর যৌথ সম্পাদনায় দিল্লির নির্বাচিত বাংলা কবিতা সংকলনের মোড়ক উন্মোচন উপলক্ষে কবিদের অনুষ্ঠান আয়োজন এবং পরের বার তার বর্ষপূর্তিতে রাইসিনা সাহিত্য উৎসবের আয়োজনে “তাঁর” ভূমিকা আমি নিজে চোখে দেখেছি। এইতো গতবার সমস্ত প্রস্তুতি পুরো করে নিজেই গাড়ি চালিয়ে আমাদের নিয়ে গেলেন উত্তরাখন্ডের রুদ্রপুর। সেখানে শক্তিফার্মের বাঙালিদের সঙ্গে গোটা দুদিন আমরা কাটালাম তাঁদের সুখ-দুঃখের কথা শুনে, সেখানে বাংলাভাষা শিক্ষার বর্তমান পরিস্থিতি, বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতির গতিবিধি সম্পর্কে অবহিত হলাম। সেখানকার একটি স্কুলে এই উদ্দেশ্যে আয়োজিত এক বিশেষ অনুষ্ঠানে আমাদের সাধ্যমত পরামর্শ দেওয়া, স্কুল পড়ুয়াদের হাতে সামান্য কিছু শিক্ষার উপকরণ তুলে দেওয়া এবং প্রবাসে বাংলাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজে তাদের সাথে থাকার প্রতিশ্রুতি দিলাম আমরা। এক্ষেত্রেও এই মানুষটির নেতৃত্বেই আমরা উৎসাহিত হয়েছিলাম।

বেশ কয়েকবার একসঙ্গে একাধিক সাহিত্য সভায় যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। তাছাড়া আমরা তিনজন সময় পেলেই নিরুদ্দেশ যাত্রায় কবিতা পড়তে কখনও চলে যেতাম সুলতানপুর বার্ড স্যাংচুয়ারী, কখনও ভরা ভাদরে বন্যা প্লাবিত যমুনা পরিদর্শনে ওয়াজিরপুর ব্যারেজ আবার কখনও আমার প্রিয় সুসজ্জিত ল্যুটেন্স দিল্লির স্নিগ্ধ সকালের গোলাপ বাগিচা। এই সব আপাত দৃষ্টিতে ছোট ছোট ঘটনা মনে হলেও জীবনের সামগ্রিক দলিলে এর গুরুত্ব অপরিসীম। আর বিশেষ করে যখন এই টুকরোগুলোকে একসুত্রে গ্রথিত করে লিপিবদ্ধ করা হয়। তিনি বরাবরই সেই সুত্রটির কাজ করে থাকেন।

বিগত একটা সুনির্দিষ্ট সময়কালের হিসেব যদি দেখা যায় ‘রাধিকা’,‘তেত্রিশ ফুটা’, ‘আমার গলির মাথা’, জুতোর দোকানের সিঁড়ি, ‘কফি ক্যাফে’, ‘রিফিউয়েল’ এই কথাগুলো বার বার ব্যবহার হয়েছে আমাদের মধ্যে, আমাদের কবিতা পঙতিতে এই সব শব্দবন্ধ স্থান করে নিয়েছে, আমাদের কন্ঠে উচ্চারিত হতে হতে জানি না কখন কল্পলোকের কবিতা এবং দৈনন্দিন জীবনের বাস্তবতা মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। এই সব কিছুর মধ্যে তাঁর জোরালো অবস্থান এবং সশব্দে সোচ্চার উদঘোষণা আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছে বারংবার। পিথ্রির এই আর এক পি হলেন পীযূষবাবু অর্থাৎ পীযূষকান্তি বিশ্বাস।

এতক্ষণ আপনারা শুনছিলেন কবি ও সম্পাদক পীযূষকান্তি বিশ্বাসের কথা।বাংলাদেশ থেকে ফেরার পথে আমরা নদীয়া জেলার বহিরগাছিতে পীযূষবাবুর গ্রামের বাড়িতে তাঁর দুই দাদা পল্লবকান্তি এবং পলাশকান্তি বিশ্বাসের আন্তরিক আতিথেয়তা গ্রহণের সুযোগ পেয়েছি। স্বল্প সময়ের প্রস্তুতিতে স্থানীয় সম্মানীয় সাহিত্য প্রেমিদের একত্রিত করে অতি সুন্দর এক কবিতা পাঠের আসর বসিয়ে আমাদের প্রতি যে সম্মান তাঁরা প্রদর্শন করেছেন, তা নজিরবিহীন। দিল্লিতে পীযূষবাবুর বাড়ির অবারিত দ্বার। বাংলাদেশ, নেপাল, কলকাতা এবং দেশ বিদেশের পরিচিত কবি সাহিত্যিকরা দিল্লিতে এলে তিনি তাদের আমন্ত্রণ করেন, আপ্যায়ন করেন, উদযাপন করেন। তাঁর স্ত্রী বিউটি বিশ্বাসের সানন্দ সহাস্য সহযোগিতা পীযূষবাবুর এই যাত্রাপথকে নিঃসন্দেহে মসৃণ করেছে। পীযূষবাবু তাঁর ঘটনাবহুল জীবনের পঞ্চাশ বছরে পদার্পণ করতে চলেছেন। কবিতা লেখা, পত্রিকা সম্পাদনা, নবাগতদের লেখায় অনুপ্রাণিত করা এবং সর্বোপরি বাংলা ভাষার প্রতি যে ভালোবাসা নিয়ে পীযূষবাবু নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন তার সুফল ইতিমধ্যেই পরিলক্ষিত। তাঁর সম্পাদনায় দেহলিজ সাফল্যের সঙ্গে অনেকটা পথ পাড়ি দিয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে ফুলে ফলে পল্লবিত হয়ে তার সুখ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে। বাংলার জন্য, বাংলা ভাষার জন্য, বাংলা কবিতার জন্য যে আর্তি যে দৃঢ়তা আমি তাঁর মধ্যে দেখেছি একদিন এইপথ ধরেই এক আলোকিত সমাজ গড়ে তোলার যে স্বপ্ন তিনি দেখেন তা বাস্তবায়িত হবে কবি পীযূষ বিশ্বাসের প্রতি এই বিশ্বাস আমাদের আছে।