পল্লবকান্তি বিশ্বাস
বহুমুখী প্রতিভার মেধাবী ছোটভাই পীযূষ
পল্লবকান্তি বিশ্বাস
পীযূষের শেকড় খুঁজতে গেলে দেখা যাবে জ্ঞানেন্দ্র নাথ ও করুণাময়ীর চার সন্তানের কনিষ্ঠ পুত্রটি পীযূষকান্তি বিশ্বাস। পিতা চাষবাসের অবসরে লালনগীতি চর্চা ও সাধুসঙ্গে রুচি রাখতেন। তৎকালে, লালনগীতি পরিবেশনের জন্য আকাশবাণীর রেডিও সেন্টারে ডাক পেলেও অর্থাভাবে অংশগ্রহণ করা হয়ে ওঠেনি। দু’মুঠো অন্ন যোগানোই ছিল যেখানে প্রধান লক্ষ্য, সেখানে গান-বাজনা, সাহিত্য-চর্চা, খেলা-ধূলা একেবারেই ছিল বিলাসিতা। যদিও বীজ মাটি ফুঁড়ে বের হয়। একসময় পিতার লেখা জ্ঞানেন্দ্রগীতি বইখানি প্রকাশ পায় ও বিখ্যাত বাউল গবেষক শক্তি নাথ ঝাঁ এর গ্রন্থে গবেষণায় পিতার গান স্থান পায়।
ছোটবেলাতেই পীযূষের প্রতিভার ছাপ লক্ষ্য করা যায়। শিশুবয়সে অক্ষর জ্ঞানের পাঠ নিতে নিতে ""অ" য় অজগর আসছে তেড়ে, আমটি আমি খাবো পেড়ে" বইটি কন্ঠস্হ হয়ে গেলে ( ক্লাস ওয়ান-টুতে) বড়োদের অবাক করে অধিকাংশ বর্ণ দিয়ে পীযূষ নিজেই অনুরূপ একটি ছন্দময় ছড়া বই বানিয়ে ফেলে।
ক্লাস ফোর বা ফাইভে লেখা:-
"মামা বাড়ি দূরে বলে জ্যাঠা বাড়ি যাই,
ছোট ছোট আমের গুটি তাই কুড়িয়ে খাই।"
পরবর্তীতে বড়দা পলাশকান্তি বিশ্বাসের অনুপ্রেরণায় ও প্রশ্রয়ে সাহিত্য পাঠে মনোনিবেশ বাড়ে। টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে কেজি দরে বড়দার কেনা পুরাতন একাধিক পত্রিকা, যেমন আনন্দমেলা, আনন্দ বাজার, দেশ, আনন্দলোক, আজকাল, বর্তমান, শুকতারা, কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান, ইন্দ্রজাল, সানন্দা, চাঁদমামা ইত্যাদি পত্রিকার সাথে পীযূষের পরিচয় ও সম্পর্ক গাঢ়তর হয়ে ওঠে । জয় গোস্বামী, জীবনানন্দ ও বিখ্যাত কবির দুর্বোধ্য কবিতাগুলো নিয়ে বড়দার কাছে পাঠ নিতে দেখেছি। কিশোর বয়সে বড়দার বন্ধু গৌতম অধিকারী, জয়প্রকাশ গুপ্ত, বিথিকা দিদিমনি ও চাঁদমামা প্রকাশক বি বিশ্বনাথন রেড্ডি সাক্ষাৎ লেখালেখির মানসিকতা গঠনে সহায়তা করে। যদিও দারিদ্র্যতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জেতাই ছিল তার ছোটবেলার প্রধান ও একমাত্র লক্ষ্য।
পীযূষের সকল ইন্দ্রিয়গুলো ছিল সজাগ ও জাগ্রত এবং ইন্দ্রিয়গুলোর সাথে মনের সংযোগ ছিল অসাধারণ। বন্ধু-বান্ধবদের সাথে পথ চলতে ওকেই দেখেছি/শুনেছি, একাধিক বার কিছু কুড়িয়ে পেতে। যেটা অন্য বন্ধুদের নজরে পড়ত না অথচ সেটা ওর নজরে এসে যেত।
পড়াশুনায় ছোটবেলা থেকেই ছিল মেধাবী। বাবার কঠোর শাসন ও বড়দার আদর্শকে সামনে রেখে বেড়ে ওঠা। অর্থকষ্টে ক্লাসের সবগুলো পাঠ্যবই অনেক সময়ই কেনা হয়ে উঠত না। সহপাঠীদের কাছ থেকে বই ধার করে পড়ে নিতে হত। কখনও পুরানো ছেঁড়া বই হাফ দামে কেনা হত, হয়ত বা কোন কোন বইয়ে বেশ কিছু পাতা থাকত মিসিং।
একা একা নিজের মত করেই পড়েছে। বই নিয়ে ঘন্টা পর ঘন্টা কখনও পড়তে দেখিনি। তবে বরাবরই ক্লাসে 1st-2nd পজিশন পেয়ে এসেছে। জীবনে কখনও টিউসন পায়নি। মাধ্যমিকে ১৯৯০ ব্যাচে বহিরগাছি উচ্চবিদ্যালয় থেকে মাত্র একজনই প্রথম ডিভিশনে পাশ করে, সে ছিল পীযূষ। ১৯৯২ সালে রানাঘাট কলেজ থেকে ১২ ক্লাসে সায়েন্স শাখায় ২৯ জনের মধ্যে মাত্র একজনই পাশ করে এবং সেই একজনই ছিল পীযূষ।
মাত্র সতেরো বছর বয়সে, মাধ্যমিক পাশের যোগ্যতায় Air Force -এর চাকরির পরীক্ষায় বসা, সকালে পরীক্ষা বিকালে রেজাল্ট এবং সাফল্য। তৎক্ষনাৎ পাশপোর্ট সাইজের ফটো দিতে না পারায় নিয়োগপত্র বাতিল। হতাশা নিয়ে বাড়ি ফেরা। ফের নতুন উদ্যমে ৬-মাস পর একই চাকরির পরীক্ষায় বসা এবার পকেটে পাশপোর্ট সাইজের ফটো । এবং পুনরায় সাফল্য। চাওয়ার আগেই পাশফোর্ট সাইজের ফটো জমা। যথারীতি নিয়োগ পত্র নিয়ে বাড়ি ফেরা। এত ছোট বয়সে চাকরি, অনেকটা দূর তার উপর Force এর চাকরি, বাড়ির লোক দ্বিধাগ্রস্থ। আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি চাকরিতে পড়ার সুযোগ থাকায় কেউ জোরপূর্বক চাকরিতে যোগদান করতে বারণ করেনি। সেই সময় সকলের ধারনা ছিল Air Force -এ মেধাবী ছাত্রদের পড়াশোনা করার সুবিধা আছে।
যাই হোক প্রথম চাকরি হিসেবে এয়ারফোর্সে যোগদান। যদিও মেধার তুলনায় চাকরির পদ ছিল ছোট ও বেমানান। চাকরিতে ঢুকে হতাশা গ্রাস করে। প্রধান কারণ পড়াশোনা করার সময় নেই। শুরু হল নতুন লড়াইয়। চাকরির পাশাপাশি নতুন করে পড়াশুনার প্রস্তুতি। দিনে চাকরি রাতে পড়াশুনা। অমানুষিক পরিশ্রম, অধ্যাবসায় এবং দৃঢ় সংকল্পে একটার পর একটা পরীক্ষা দিয়ে অবশেষ MCA পাশ। পরবর্তীতে জটিল পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে এয়ারফোর্স চাকরি থেকে অব্যাহতি পাওয়া ও প্রাইভেট চাকরিতে সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার যোগদান ও বিদেশ গমন।
বিভিন্ন কোম্পানিতে সুনামের সাথে কাজ করে পেয়েছে অনেক সম্মান। কম্পিউটার সফটওয়্যার সম্পর্কিত তিন-চারটে প্যাটেন্ট রয়েছে তার নামের পাশে।
লক্ষ্য করেছি, ও যা কিছু করতে চেয়েছে সব ক্ষেত্রেই মুটামুটি সাফল্যের ছাপ রাখতে পেরেছে। খেলাধুলায় যথেষ্ঠ নাম ছিল। স্কুলে দৌড় ও লং জাম্পে প্রাইজ নিশ্চিত ছিল। ক্রিকেটে ব্যাটিং-বোলিং -এর পারফরম্যান্সের পারদর্শীতায় ছোটবেলায় এলাকার বড়দের ক্রিকেট দলে ঢুকে অসাধারণ ইনিংস খেলার নজির রেখেছে। ক্রিকেট মরসুমে হায়ারে বিভিন্ন দলে খেলে বেড়াত।
স্কুল-কলেজে পড়াকালীন শখ করে কবিতা লিখলেও এয়ারফোর্স চাকরিতে থাকা কালীন অজস্র সিরিয়াস কবিতা লিখেছে। পরবর্তীতে দিল্লীতে বসবাসের সুযোগে একাধিক সাহিত্য জগতের মানুষের সান্নিধ্য তার লেখা-লেখির মানকে উন্নত করেছে ও আরো বেশি পরিচিত দিয়েছে।
পায়ের তলার মাটির ভিতকে শক্ত করতে জীবনের অধিকাংশ লড়ায়ে নিজেকে লড়তে হয়েছে একাই। ওর স্ত্রী, বিউটি বিশ্বাস সর্বদা তার পাশে থেকে যথাসময়ে যোগ্য সহযোগিতা করে গেছে। একমাত্র সন্তান ঋজুস্মিত পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে পিতামাতার আশা পূরণের পথে এগিয়ে চলেছে।
ছোট ভাইয়ের বহুমুখী প্রতিভার বিকাশে তার পরিবারের আমরা সবাই গর্বিত। তার ৫০ তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে রইল আমাদের এক আকাশ শুভেচ্ছা।