শিবু মণ্ডল
ব্যক্তি পীযূষ কবি পীযূষ
শিবু মণ্ডল
পীযূষ বিশ্বাসের সাথে আমার প্রথম পরিচয় ২০১৭ সাল নাগাদ ফেসবুকের মাধ্যমেই। হ্যাঁ মেসেঞ্জারেই প্রথম আলাপ। আসলে আমিই প্রথম যোগাযোগ করেছিলাম দিল্লি নিবাসী কবি ও সম্পাদক পীযুষ কান্তি বিশ্বাসের সঙ্গে। তখন সবে হেমন্তলোক পত্রিকার বীজ আমার মন ও মস্তিষ্কে দানা বেঁধেছে। হরিদ্বারে বসেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বাংলা ভাষার কবি ও সাহিত্য কর্মীদের সাথে যোগাযোগ করছি, লেখা সংগ্রহ করছি। তখন মূল চ্যালেঞ্জ ছিল পত্রিকা কোথা থেকে ছাপাবো। মনে হল কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গ হৃদয়ের যত কাছেই থাক না কেন বাস্তবে অনেক দূর। তার চেয়ে বরং দিল্লি অনেক কাছে। পীযূষ বিশ্বাস তখন দিল্লিতে বসে বাংলা অনলাইন পত্রিকা শুন্যকাল সম্পাদনা করে চলেছেন। মনে হল তিনিই কোনও পথ দেখাতে পারেন। তিনি দিল্লির এক প্রেসের কন্টাক্ট নম্বরও দিয়েছিলেন মনে পড়ে। যাই হোক পরে হেমন্তলোকের আত্মপ্রকাশ ঘটে এবং শত বাঁধা ও চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও প্রিন্ট করা হয় কলকাতা থেকেই। এখনও সেখান থেকেই ছাপা হয়। প্রথম সংখ্যায় পীযূষদার কাছে কবিতাও চেয়েছিলাম, কোনও কারণে তিনি তা দিয়ে উঠতে পারেন নি। তবে নিয়মিত যোগাযোগ গড়ে ওঠে, গড়ে ওঠে এক বন্ধন। আর এই বন্ধনের সূত্র হল ভাষা, বাংলা ভাষার প্রতি আমাদের ভালোবাসা ও দায়বদ্ধতা। এরপর ২০১৮ সালে দেহ্লিজ নামে একটি নতুন অনলাইন পত্রিকার সম্পাদনা শুরু করেন তিনি। সেখানে লেখালেখির সুবাদে এক আত্মিক সম্পর্কও গড়ে ওঠে। ফোন করে ‘কেমন আছ রে ভাই শিবু?’ বলে যখন কথা বলা শুরু করে তখন এই ভেবে আশ্বস্ত হই যে বঙ্গভূমি থেকে ১৫০০ কিমি দূর প্রবাসেও একজন পড়শি আছেন যিনি এমনভাবে খোঁজ খবর নেন মাঝে মধ্যে।
আগামি ১৫-ই মে আমাদের তরুণ কবি ও সম্পাদক পীযূষ কান্তি বিশ্বাস পঞ্চাশটি বসন্ত পার করে যাবেন। সেই শুভ মুহূর্তটিকে উদযাপন ও স্মরণীয় করে রাখতে আমাদের দেহলিজের আরেক আত্মীয় দিল্লির বর্ষীয়ান কবি প্রাণজি বসাক এক উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ নিয়েছেন। দেহলিজের বিশেষ সংখ্যা ‘৫০ এ পীযূষ’ সম্পাদনার দায়িত্বভার তুলে নিয়েছেন তিনি। প্রাণজিদা অনেকদিন থেকেই তাগাদা দিচ্ছেন এই বিশেষ সংখ্যায় লেখার জন্য। কিন্তু কী লিখব কী লিখব করে শেষে মনে হল যে পীযূষদার কবিতা নিয়ে তো অনেকেই লিখবেন, আমি ব্যক্তি পীযূষ নিয়ে কিছু কথা বলি। গতবছর এক পারিবারিক ভ্রমণে এসেছিলেন তিনি হরিদ্বার। শিবালিক পাহাড়ের বরফ একটু একটু করে গলতে শুরু করেছে সবে। মার্চের শুরুতে বনের শুকনো পাতার মতো মাটি আঁকড়ে পরে থাকা হালকা শীতের সন্ধায় সপরিবারে এসে উঠলেন গঙ্গা কিনারের এক হোটেলে। মনে পরে দিনটি ছিল শিব রাত্রি। পরের দিন একসাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হরিদ্বারের অলিগলিতে ঘুরে বেড়ালাম। তারপর দিনশেষে হর-কি-পৌড়িতে গঙ্গা আরতি দর্শন। এই দর্শন যতটা পার্থিব তটটাই অপার্থিব বটে। গঙ্গার স্বচ্ছ নীল জল বয়ে যায়। গঙ্গা নিজেও এক দর্শন। তার পাড়ে এসে আমরা মিলিত হই শুধু এক নদীকে দেখব বলে তো নয়। আমরা একে অন্যকেও দেখব বলেও তার ধারার সামনে এসে বসি। পীযূষ বিশ্বাস দিল্লির কবি বলে বিশেষভাবে পরিচিতি লাভ করেছেন। তার কাব্যভাষা ও লিখনশৈলী আরাবল্লির লুপ্ত পাহাড়ের লু বাতাসে দিল্লির বাদশার উত্তরাধিকারী মুকুটের মতো উজ্জ্বল। হরিদ্বারের ঘাটে বসে তিনি দেখছেন জলের বয়ে যাওয়া। জলের ধর্মই তো বয়ে যাওয়া। কে আর আটকে রাখতে পেরেছে নদীর প্রবাহকে! হিমবাহ থেকে চুইয়ে পড়া একটু একটু জল কতটা পথ অতিক্রান্ত হলে একটি ধারার সৃষ্টি হয়? পাশে বসে ভাবছিলাম সেই কথা। বহিরগাছির এক সাধারণ কৃষক পরিবারের সদ্য কৈশোর পেরোনো ছেলেটি তার ভবিষ্যৎ দেখতে পেয়েছিল নিশ্চিত। তাইতো একটুও সময় নষ্ট না করে সে আঠারোর বছর বয়সেই স্বপ্নের প্রথম উড়ানটি দিয়েছিলো। ভারতীয় বায়ুসেনাতে যোগ দিতে তার কোনও দ্বিধা কাজ করেনি। উড়ান যার ডানায় ডানায় গাঁথা অক্ষরের মতো সেতো উড়বেই। কখনো কাশ্মীর কখনো ব্যাঙ্গালোর। নদীর মতোই নিরন্তর বহমান এক জীবনে কত মাত্রা থাকে মানুষ নিজেই জানে না। যে জানে, যে চিনতে পারে তার কাছে ভেসে থাকা, পাথরে পাথরে ধাক্কা খেতে খেতে বয়ে যাওয়া একই ব্যাপার। এগিয়ে চলাই তার ধর্ম। কর্মই তার সাধনা। সদা কর্মচঞ্চল পীযূষ বিশ্বাস সেদিন আধ ঘণ্টার জন্য স্থির বসে থাকলেও আসলে সে কি বসে ছিল? সে তখন দেখছে আগামীকাল বাংলা ভাষা কোথায় নোঙর ফেলবে। দুই বঙ্গ ও ত্রিপুরার বাইরে বাঙালি আজ দেশ কেন সারা বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে প্রান্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। সে তো ভালো কথা, কিন্তু ভাষা কি তেমন হারেই বিস্তার লাভ করেছে, নাকি উল্টোটাই হয়েছে? এমন প্রশ্ন একজন কবিকে তাড়িত করবে এটাই স্বাভাবিক। সেই তাড়নার বশেই পরদিন হরিদ্বার থেকে আরেকটু এগিয়ে যাওয়া। আমাদের কোনও নন্দন নেই, আমাদের কোনও লিটিল ম্যাগাজিন মেলা নেই, আমাদের কোনও কলিকাতাও নেই অতএব চলো শিবু খোলা আকাশই হোক আমাদের মঞ্চ, গাছপালা, নদী পশুপাখি সব হোক আমাদের দর্শক শ্রোতা। ‘চলুন তবে চিলা’! দেবতার দ্বার থেকে বিতাড়িত হলে, জাতীয় সড়ক থেকে আলাদা হয়ে গেলে, ধর্মের বেসাতি থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিলে দেখা পাওয়া যায় চিলার বিদ্যুৎ বন। হরিদ্বার ও হৃষীকেশের মাঝে এ যেন এক জীবনানন্দ লিখিত দারুচিনি দ্বীপ। এক অনামি পাহাড়ি ঝোরার পাড়ে কবিতার আসর যে বসানো যেতে পারে এমন অভিনব আইডিয়া কবিতা পাগল পীযূষদার ক্ষেত্রেই সম্ভব। বয়স পঞ্চাশ হলে কি হবে মন তার ষোল বছরের কৈশোরে ভরপুর। না হলে কি হাতির ভয়কে উপেক্ষা করে জঙ্গলের মাঝখানে গাড়ি থামিয়ে গাছ বইতে পারে! হ্যাঁ ঠিক তাই, ছোটবেলার মতো গাছের ডালে বসে দোল খাওয়ার মতো পাগলামি কোনও কবির পক্ষেই সম্ভব। রাজাজি জাতীয় উদ্যানের চিলা রেঞ্জের জঙ্গলে এর আগে কেউ কখনো কবিতা পড়েনি আমি নিশ্চিত আর বাংলা কবিতা তো নয়ই। সেদিক থেকে দেখলে সেদিন এক অভূতপূর্ব ঘটনার সাক্ষি থেকে গেল চিলার সেই অনামা নদী আর পাহাড় জঙ্গল। গঙ্গা ক্যানালের পাশে গড়ে ওঠা সুন্দর কাঠের টুরিস্ট বাংলোটিও সেদিন মন দিয়ে শুনেছিল বাংলা কবিতার হাল হকিকৎ।
তবে পীযূষ বিশ্বাস তো শুধুমাত্র বাংলা ভাষার কবি নন, বাংলা ভাষায় লিখলেও তিনি দিল্লির কবি। মাতৃভাষায় লেখা তার কবিতা পড়ে চলেছেন কবি। ফেসবুক লাইভ চলছে। দেখছে আপামর বাঙালি পাঠক শ্রোতা- দিল্লি থেকে, হাওড়া থেকে বাংলাদেশ থেকে। বাংলা তার মাধ্যম। সে পড়ে চলেছে দিল্লির জিন্দেগী, যমুনার কালো থেকে মানচিত্রের আরাবল্লি। পড়তে পড়তে সে আসলে লিখে চলেছে দিল্লিকে। দিল্লির তাপমাত্রার ওঠাপড়া তার কবিতায় স্পষ্ট। গ্রাম বাংলার স্মৃতির চেয়ে দিল্লির দরবারের হাল হকিকত, সেই মহানগরের নাগরিক যন্ত্রণা ছাপ রেখে যায় তার কবিতায়। ২০ বছরের বেশি হবে তিনি মহাবীর এনক্লেভের স্থায়ী বাসিন্দা। খুব সহজেই সেই শহরের অর্থনীতি, সামাজিক বৈষম্য, মায়া ও নিষ্ঠুরতা সেই শহরের মতই একটু একটু করে বিবর্তিত করেছে কবি ও লেখক পীযূষ কান্তি বিশ্বাস কে। সে পড়ে চলেছে- ‘ তবু যদি দেখো, গল্পের শুরু/ তার চলন, বাঁকা বা স্পিড ব্রেকার/ এই এক রৈখিক হাইওয়ের মত কোন যাত্রা/ রাস্তার ঝাঁকুনি নিয়ে চালকের মনে সংশয়/ কবির মনে বসে থাকা কোন চেতনায় তার সিনট্যাক্স ভেঙ্গে যায়/ কলাই থেকে খুলে পড়ে যায় ঝুমকা/ সদ্য কৈশোর পেরোনো রাধিকা রাধিকা সবুজ সালোয়ার কামিজ/তার সদ্য কৈশোর পেরোনো বুঝি আর পেরোয় না/ তার সদ্য থামিয়ে দিয়েছে এই মে জুনের দিল্লি/ এয়ারপোর্টের মেট্রো এই থমকে দাঁড়ালো,/ লো-রাইড বাস এই রুখকে/ মানুষ আর কংকাল নিয়ে সমগ্র দ্বারকা/ চারিদিকে ঘিরে আসে গম কেটে আগুন লাগানো ধোঁয়া/ দূষিত নিঃশ্বাস সহ দ্বারকা সেক্টর ওয়ান এক্সটেনশন/ পালাম ফ্লাইওভারে সমগ্র ট্র্যাফিক আজ থমকে দাঁড়িয়ে...( ‘চুড়ি টুটি’ কবিতার অংশ বিশেষ)। এই একটুকরো কবিতা থেকেই লেখকের নিজস্ব ধারা চেনা যায়। এই ধারাটি নিঃসন্দেহে দিল্লির ধারা। ভারতবর্ষের নানা প্রান্তের সংস্কৃতি, ভাষার ধারা এসে মিশেছে দিল্লির সাহিত্য চর্চাতেও।
ভাষা বেঁচে থাকে সাহিত্যে। বেঁচে থাকার তাড়নায় মানুষ স্থান বদলায়, জীবিকা বদলায়, ভাষাও বদলায়, তারপরও বুকে বয়ে নিয়ে বেড়ায় মাতৃভাষা। কালের নিয়মে তার মননে, চিন্তায় বিবর্তনের ছাপ পড়ে, কিন্তু ভাষা অন্তঃসলিলা হয়ে প্রেরিত করে। কবি একসময় বুঝতে পারে, পরিবর্তন ধ্রুব সত্য। কিন্তু মাতৃভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে কলম তুলে নেওয়া যেমন জরুরি তেমন সংঘবদ্ধ হয়ে সাহিত্যকে বাঁচিয়ে রাখাটাও কর্তব্য। পীযূষ বিশ্বাস যেমন একজন কবি তেমনি একজন সংগঠকও বটে। দিল্লিতে বসে যেমন তিনি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করে চলেছেন তেমনি নানা ভাষা ও সাহিত্যিক কর্মকাণ্ডের সাথেও যুক্ত আছেন। এই সম্প্রতি সেই সংগঠক পীযূষ বিশ্বাসকে আরও একবার কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা হল। এবারে তিনি নোঙর ফেলেছেন শক্তিফার্মে। উত্তরাখণ্ডের রুদ্রপুর শহরের কাছেই এক অজ্ঞাত গ্রাম বাংলা। তবে আমার কাছে অজ্ঞাত ছিল না। আমার ছোট পিসি বিয়ে হবার পর পিসেমশায়য়ের সাথে এই শক্তিফার্মেই চলে আসেন। দেশভাগের পর পিসেমশাইয়ের বাবা সপরিবারে বাংলাদেশ থেকে রিফিউজি হিসেবে এই জঙ্গলের দেশে চলে এসেছিলেন আরও অনেক পরিবারের সাথে। শক্তিফার্ম ও আশেপাশের শহর গ্রাম মিলে দুই লক্ষের উপরে বাঙ্গালির বাস এই উধমসিং নগর জেলাতে। এত বাঙালি যেখানে বসতি গড়েছে সেখানে বাংলা ভাষার কী হাল হকিকত্? সেই অনুসন্ধিৎসাই কবি ও সংগঠক পীযূষ বিশ্বাসকে তাড়িত করেছিল নিশ্চিত। তার ডাকে সারা দিয়ে আমরা ছুটে গিয়েছিলাম শক্তিফার্মে। সঙ্গ দিয়েছিল দিল্লির বর্ষীয়ান কবি প্রাণজি বসাক, ও বাচিক শিল্পী প্রণব দত্ত। প্রবাসী বাঙ্গালির জন্য দেখেছি এক প্রবাসী বাঙালি কবির মনের টান ও ভালোবাসা। দেখেছি মাতৃভাষাকে বাঁচিয়ে রাখবার জন্য এক বাঙালি কবির উতলা হয়ে ওঠা।‘ কিছু একটা করতে হবে, বুঝলে শিবু, শক্তিফার্মের জন্য!’ পীযূষ বিশ্বাসের কণ্ঠে এই আকুলতা শুধু একজন কবির আর্তি নয় একজন মানুষের তার সত্তাকে ছাপিয়ে যাবার আকুলতা যেন! দেখেছি শত ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি শক্তিফার্মের গণ্যমান্যদের সাথে সেদিন এক আলোচনা সভার আয়োজন করেছিলেন। কীভাবে বাংলা ভাষাকে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য পুনরুজ্জীবিত করা যায় দেখেছিলাম তার রুপরেখা তৈরি করতে। এভাবেই কবি পীযূষ ও ব্যক্তি পীযূষ বিশ্বাসকে আমি দেখেছি। আগামিদিনেও তার লেখাকে ও ব্যক্তিসত্তাকে হয়তো অন্য দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখবো। তবে সেদিন শক্তিফার্মের চতুর্থ প্রজন্মের ছোট ছোট শিশুদের হাতে দিল্লি থেকে নিয়ে যাওয়া আদর্শ বর্ণলিপি বই নিজহাতে তুলে দেওয়া পীযূষদার হাসিমুখের ছবিটিই কিন্তু আমার মনে চিরস্থায়ী হয়ে রয়ে যাবে! এই ছবিই ব্যক্তি পীযূষের ট্রেডমার্ক! এই ছবিই কবি পীযূষের প্রেরণা স্রোত!
Tags:
ক্রোড়পত্র