অজিতেশ নাগ
উপলব্ধ
অজিতেশ নাগ
একজন পূর্ণবয়স্কা নারী (কাব্যি করে বলতে গেলে এমনভাবেই তো বলতে হয়) একটা ডবকা ছেলেকে দেখলে, হোক আড়চোখে তবুও, টুকটাক করে দেখবেই, ভাল লাগবেই, এতে লুকোচুরির কী আছে? মা খুব ভাট বকে, সত্যি। মা বলে, ছেলেরা সব নাকি হেব্বি বদমাশ, মেয়ে ধরার জন্য ওত পেতেই আছে। এমনটি হতে পারে? বৃন্দা, আমার প্রিয় বন্ধু, বলে, “ছেলেরা হল পাখি আর মেয়েরা ফাঁদ। একেবারে ট্র্যাপার।” এটা অবশ্য ওর নিজস্ব ইংরেজি, অভিধানে নেই। আমিও বুঝেছি, এই জন্যই বলে, ঘুঘু দেখেছ, ফাঁদ দেখনি? ছেলেরা হল প্লাগ আর মেয়েরা সকেট। মানে সকেটে ঠিকঠাক লাগাতে পারলে... নাহহ, অ্যাডাল্টেরিও কথাবার্তা হয়ে যাচ্ছে। যদিও আমি বড় হয়েছি, মানে কবির ভাষায় পূর্ণবয়স্কা নারীদেহ প্রাপ্ত (নাকি প্রাপ্তা?) হয়েছি। আচ্ছা, বলুন, এই বয়সে ভাল লাগালাগি, বাসাবাসি হবে না তো কবে হবে? মুন্নিপিসির বয়সে গিয়ে? না, প্রেমের যদিও কোন বয়স নেই, তবুও...।
দাঁড়ান, দাঁড়ান, আগে নিজেকে ইন্ট্রোডিউস করি, নইলে আমি কে কতা কইচি বুজতেই পারবেন নি কো। হিহি। আমি পশমিনা বসু। নাম শুনে ফোরহেডে চোখ? এ নাম রেখেছিল আমার একমাত্র বাপি, মানে বাবা আর কী। ভদ্রলোক সারাজীবন কাশ্মীর কাশ্মীর করেই কাটিয়ে দিল, দীঘা আর দার্জিলিং ডিঙিয়ে আর কোথাও পা বাড়াতে পারল না। তবে আমি ভাল মেয়ে, কথা দিয়েছি, চাকরি পেলে বাবাকে একদিন ঠিক কাশ্মীর দেখিয়ে আনব। তো আমার সেই কাশ্মীরপ্রেমি বাবার সব প্রেম ঝরে পড়ল সদ্যজাত আমারই উপরে। জন্মেই নাম পেলাম পশমিনা। দুত্তেরি। মা ডাকে মিনা। সেটা আরও অসহ্য। বন্ধুরা ডাকে পমি। সেই ডাকেও কুত্তাগন্ধ লেগে থাকায় অ্যাট লাস্ট পম-এ ফাইনালি ল্যান্ডিং। বাঁচা গেল।
এসেছি একটা থিয়েটার দেখতে। আকাদেমিতে। সঙ্গে? না, সঙ্গে আর কেউ নেই। রিস্টওয়াচ জানাচ্ছে, আরও পনের মিনিট আরামসে আমি ল্যাদ খেতে পারি। হরিদার দোকানের চা, বড় ভাঁড় লাল, শেষ, একটা সিগারেটে সবে মুখাগ্নি করেছি, উই মা! ওটি কে?
কী বলব মশাই! তাকালাম, দেখলাম, ফিদা হলাম। ভাবছেন, তাকালাম আর দেখলামের মধ্যে ফারাক কী? আছে মশাই আছে। তাকানো মানে আলগোছে চোখ বুলিয়ে নেওয়া আর দেখা মানে এক্কেরে... কী আর বলি।
ছেলেটিকে দেখলাম। একবার, দুবার, তিনবার। তারপর দেখতেই লাগলাম। না, ডাইরেক্ট কন্টিনিউয়াস হিট করতে থাকলে ভাল দেখায় না। ছেলে হলে দিব্যি ঝারি-মারা-ইমেজ সাঁটিয়ে হা-ক্লান্ত দেখতাম। মেয়েপক্ষ বলে (কাণ্ড দেখুন, এখন থেকেই আমার কেমন বিয়ে পাচ্ছে) অতটা মানায় না। বয়স আন্দাজ ছাব্বিশ হবে। কম বেশি হলেই বা কী যায় আসে? লম্বা? তা ধরুন আমি পাঁচ সাত আর সে পাঁচ দশ কী এগারো। এক্কেরে চিল-মার কেস। তাই না? হাল্কা ফরসা রঙ, মুখ একেবারে মাখন ক্লিন। কী কাণ্ড দেখুন, পূর্ণবয়স্কা নারী হওয়ার ব্রোঞ্জযুগ থেকেই আমার দাঁড়ি পছন্দ। না, মানে তাই বলে হুমদো দেঁড়েল নয়, হাল্কার উপরে ট্রিমার চালানো গাল হবে। দু চারটে ব্রণ হলে তো কথাই নেই। উফফ! কিন্তু এখন আমি কী করি? সিগারেটে পঞ্চম টান দিয়ে ফের তাকালাম। ছেলেটা চা নিয়েছে। দুধ-চা। সঙ্গে কেক। যাহ কেলো, এ ব্যাটা নির্ঘাত উত্তর কোলকাতার মাল। এ মা! কী সব উগরে ফেলছি!!
ছেলেটা ধীরেসুস্থে কেক খাচ্ছে। এই মুহূর্তে যদি ওর গলায় কেক আটকে যায়, তবে তো জলের দরকার পড়বে। হ্যাঁ। ভাল করে তলিয়ে ভাবলাম। তখন যদি.... আমি কাঁধের ব্যাগের ভেতরে জলের বোতলে অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে হরিদার দোকানের দিকে এগিয়ে গেলাম। ফিল কল্লাম, হু, একটু প্রেম প্রেম পাচ্ছে বটে। ফের আড়চোখে তাকালাম। ইসস। এক কুচি কেক চিপকে আছে ওর পুরু ঠোঁটের উপরে। না। নিজেকে সামলালাম নিজেকে। হাত বাড়িয়ে কেকের ঝুল ঝাড়াটা বাড়াবাড়ি লেভেলের হয়ে যাবে। কিন্তু শুধুমুদু দোকানের সামনে শাড়ির দোকানের মডেল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকাটা আলফাল কন্সেপ্ট। অতএব, “হরিদা, একটা লাল, বড়।”
ধুত, একটিবার তো ফিরে তাকাবি? পাশেই একজন মোটামুটি তন্বী হাপিত্যেশ দাঁড়িয়ে আর এখন তোর কাছে কেকটাই বড় হল? ফের আড়চোখ। কেক সমাপ্ত। হাতের পিঠ দিয়ে মুখ মুছে এবার চায়ে চুমুক। এই রে! চা শেষ করেই কেটে পড়বে নাকি? এদিকে আমার হাতে ভাঁড়, ল্যান্ড করেছে ঠিকই, তবে আগুন আগুন তরল আমি একেবারে জিভে ঠেকাতে পারি না। আহা, হাসার কী আছে, জিভ তো শরীরেরই অঙ্গ। শরীর আর বয়স দুটোই যদি কাঁচা হয়, তবে আলাদা করে জিভটা কি কার্বাইডে ঝানু হবে?
আচ্ছা, ছেলেটার বগলে ওটা কি? একটা বই। আমি আলগোছে ৮৫ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে মাথা ঘোরালাম। নামটা পড়তে পারলাম, তবে ছেঁড়া লুচির মতন। তবু যেটুকু চোখস্থ হল, ‘আগুন বিহ...’ লেখকের নাম নিচেই। তারও ছেঁড়া কাঁথা স্ট্যাটাস। ‘... তেশ না...’ ধ্যাত্তেরি! সাডেনলি ব্রেনে স্পার্ক ঝলসিল। এই বইটা নিয়েই তো আলোচনা করা যায়, নিদেন পক্ষে জিজ্ঞাসা? করব? যদি কিছু ভাবে? ভাবুক গে। এই মুহূর্তে বাপির মুখটা ভেসে উঠল কেন? বাপি কবে যেন বলেছিল, “ভাবিয়া করিও কাজ, তবে অধিক ভাবিও না। কাজ হইবে না।” বাট, কবে বলেছিল, সেটাই ছাই মনে পড়ছে না।
শেষমেষ ‘দুত্তোর’ বলে এক পা এগোতেই কেলো।
“সমুদা, তুমি এখানে?”
এ আবার কে? আমার জীবনটাই এমন মশাই। যা কিছু পাচ্ছি পাচ্ছি বলে মনে হচ্ছে, বেশি ভাবাভাবি করতে গিয়েই আর পাই না। নাহহ, আজ বাড়ি গিয়ে বাপিকে একটা কৌটো গিফট না করলেই নয়। বাপিকে তো খুব হাঁটাহাঁটি করতে হয়, তাই কৌটো ভর্তি করে তার লেগডাস্ট কালেক্ট করে নিলেই কেল্লাফতে।
উচ্চতা মাঝারি, গায়ের রং বিজ্ঞাপনের ল্যাঙ্গুয়েজে ‘উ শ্যা’ মানে উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। কাঁধে একটা ঝোলা। তার মধ্যে থেকে রোল করা কিছু পেপার উঁকি পারছে। ইতিমধ্যে ছেলেটি জিজ্ঞেস করে ফেলেছে, “আমি তো এসেছি একটা কাজে, তুমি এখানে কী করছ? চা খাবে?”
গা জ্বলে গেল। ‘তুই’ করেও তো বলতে পারতিস? তাহলে বুঝতাম সিস্টার লেভেলের কেস। মেয়েটা তত ক্ষণে জবাব দিয়ে দিয়েছে, “ফাইন আর্টসে এসেছি। তুমি আসবে দেখতে?”
আমি সামান্য সরে এলাম। স্থির করলাম, এবার সামান্য দূর থেকেই ব্যাপারটা সমঝে নিতে হবে। ছেলেটি বলল, “এখন তো একটু ব্যস্ত আছি গো।”
‘গো’?? উফফ। এ ঠিক প্রেমিকা না হয়ে যায় না। তবে আজকাল অনেক ছেলেমেয়েই কথার লেজে ‘গো’ জুড়ে দেয়। আন্তরিকতার পরাকাষ্ঠা আর কী। এই ‘পরাকাষ্ঠা’ শব্দটা আমার বাপির। কথায় কথায় বলে, “সে তোরা সুইটজারল্যান্ড বল বা ইটালি, কাশ্মীরের মত সৌন্দর্যের পরাকাষ্ঠা কোথাও নেই।” প্রথমবার শুনেই ঘেঁটে ঘ হয়েছিলাম। কাশ্মীর আর পোড়া কাষ্ঠ!
কিন্তু এটা কী হল? ব্রেনে কুঝিঁকঝিঁক হচ্ছে কেন? ছেলেটা মেয়েটার সঙ্গে নিচু গলায় কথা বলছে কেন? কোনও পুরোনো স্মৃতি আঁচড়াচ্ছে নাকি? হে ভগবান! তোমাকে এই ক’মিনিটেই নিজেকে চরম স্বার্থপর প্রমাণ করতে হবে? তবে আমিও ছাড়বার পাত্রী নই। ‘হাউ টু হ্যাভ ভাজামাছ’ মুখ করে ওদের আরেকটু কাছে ঘনাই। এইবার মেয়েটার গলা পেলাম, “সমুদা, গোবিন্দ মণ্ডল রোডের সেই আড্ডাটা এখনও বসে?”
ছেলেটি হাসল। প্রথমবারের জন্য। মনে হল জাস্ট সিমেন্টে হড়কে যাব। এইভাবে গালে টোল ফেলে কেউ হাসে? নাকি হাসা উচিত? একটা মেয়ের বুকে যদি টনটনানি শুরু হয়, সে ‘পড়ে যাব, পড়ে যাব’ স্ট্যাটাসে চলে যায়, তুই ধরবি?
“নাহ। এখন সবাই যার যার কাছে ব্যস্ত। একদিন এসো না। কত হল?”
প্রশ্নের লেজটুকু হরিদার জন্য। দাম মিটিয়ে দেওয়ার জন্য বগল উঁচু করতেই মেয়েটির নজর গিয়েছে, “তোমার হাতে ওটা কী?”
“নাও, দ্যাখো।”
মুহূর্তে আমি ডিঙি মারি, অসভ্যের মতই। বই দেওয়ার অছিলায় আঙুলে আঙুলে চুম্মাচাটি হল কী না দেখতে। দেখতে পেলাম না। রাগ হচ্ছে প্রচণ্ড। একেই বলে শকুনের নজর। আহা, আমিই কি আর পারতাম না একই প্রশ্ন করতে? এগিয়ে গিয়ে ভনিতা করে বলতেও তো পারতাম, “এক্সকিউজ মি, আপনার হাতে ওটা কি? উপন্যাস? অ্যাকচুয়ালি, আই লাভ নভেল। মে আই…?” এই ধরণের কিছু একটা বলা। জাস্ট ফার্স্ট গিয়ারে ফেলার জন্য। মেয়েটার জন্য একটা মোক্ষম গালি খুঁজতে লাগলাম। খুঁজে না পেয়ে বিড়বিড়ালাম, “আ বে, যা না, পাতলা হ’ না। তাহলে তো আমি…”
যাহহহ। হাতের চা-টা জল হয়ে গেছে। ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছি আর ছেলেটাও হাঁটা লাগিয়েছে। মরেচে! মেয়েটি কী নির্লজ্জ! তখনও দাঁড়িয়ে বলছে, “বইমেলায় আসছ তো সমুদা?”
সমুদার মাথা তত ক্ষণে হেলমেটে ঢেকে গিয়েছে। বলল, “আসব। তুমি থাকবে?”
“আমাকে তো থাকতেই হবে।”
একটা চরম স্বার্থপর মোটরবাইক ছেলেটাকে নিয়ে উধাও হয়ে গেল। আমি আরেকটা সিগারেট ধরালাম। আজ নাটক থাক।
দুটো ক্লু পেয়েছি। ‘সমুদা’ আর ‘গোবিন্দ মণ্ডল রোড’। দ্বিতীয়টা খুব সোজা। বাড়িতে এসে ল্যাপটপ খুলে গুগলে সার্চ মারতেই বেরিয়ে এল রাস্তাটা। তার চারপাশের অনেকগুলো জায়গা আমার মাউস-ছানা ঘুরে বেড়ালো এবং এক সময় আমি লাফিয়ে উঠলাম। হয়েছে। হয়েছে। চার আর চারে আট হয়েছে। ম্যাক্সির কলার হয় না, থাকলে তুলতাম। ব্রেন আমার ন্যাচারালি ফার্টাইল। কাছেই বিশ্বভারতী ইউনিভার্সিটি। নিশ্চয়ই গোবিন্দ মণ্ডল রোডে বাড়ি আর বিশ্বভারতীতে…। ইয়াহু। কিন্তু প্রথমটার জন্য বাঁশবন আমার কাছেই এগিয়ে এসেছে। যদি ডাক নাম হয়, তাহলে হাতে হ্যাজাক। আর যদি ভাল নাম হয়, তাহলে? সমর? সমরেন্দ্র? সমদর্শী? নাকি সমর্পণ? ও মাই গড। ওরে ইয়ে-মার্কা মেয়ে, ডাকলিই যদি তবে পুরো নামে ডাকতে কি তোর ইয়েতে ব্যথা হয়েছিল? এখন আমি কী করি?
পুরো চারদিন, ভাবতে পারেন, পুরো চারদিন দাঁড়িয়ে থাকলাম বিশ্বভারতীর সামনে। দাঁড়াতে দাঁড়াতে মাঝে মাঝে নিজেকে প্রস্তরীভূত মাতঙ্গিনী হাজরা বলেও মনে হতে লাগল, তবু তার দেখা পেলাম না। তবে কি সে এখানে পড়ে না? অথবা পড়ায় না? গোবিন্দ মণ্ডল রোড এমন ভাবে ছেঁকে ফেললাম, যেন গুগলই আমার কাছে জানতে চাইবে, “দিদি, সামনের দড়িতে রঙচটা লুঙ্গি টাঙানো বাড়িটা কোথায় বলতে পারেন?” অথবা “পূব দিকের গলির পশ্চিমমুখো বাড়িটা কোথায় বলতে পারেন, যার একটা অনামুখো জানালার খিড়খিড়ির কান খুলে ঝুলছে?”
একটা লম্বাআআআআ দীর্ঘনিঃশ্বাসের সঙ্গে বইমেলা এসে গেল। প্রতিবারই যাই। দিন তিনেক। এবার দশদিনই যাব। কারণ, ‘সমুদা’ বলেছে আসবে। এক নম্বর গেট পেরিয়ে ঢুকে সোজা এগিয়ে, শামি কাবাব আর ইউরিনের পাঞ্চ-করা-গন্ধে মাতোয়ারা হওয়ার আগেই দেখতে পেলাম। দেওয়ালে ঝোলানো নানান রঙয়ের পেইনটিং আর তার সামনে সেই মেয়েটা! ও মুখ আমি ভুলি? এগিয়ে গেলাম। কেন গেলাম? কারণ তত ক্ষণে চৈত্রমাস না হলেও সর্বনাশের ইঙ্গিত পেয়ে গেছি। মেয়েটির ঘামে ভেজা হাপিত্যেস মুখের পেছনে একটা ছবি। পুরুষের। সমুদা’র।
“আপনিই আর্টিস্ট?”
“হ্যাঁ, ম্যাডাম। আঁকাবেন? পোর্ট্রেইট। বেশি না, একশো টাকা।”
আমি চিনি-চপচপে স্টাইলে হাসি, “বলছেন? বেশ। এখানে বসি?”
মেয়েটি একটি বসার টুল এগিয়ে দেয়। টেনে নেয় রঙ, তুলি, কাগজ এই সব।
আধা ঘণ্টা পরে আমি চমকাই, পিলে শুদ্ধ। কী বিটকেল মেয়ে রে বাবা। এ যেন আমিই তাকিয়ে আছি আয়নার দিকে। অদ্ভুত ক্ষমতা তো! কিন্তু আমি তো আমিই। তাই মুখ ভ্যাটকাই, “নাহ, কাঁচা হাতের কাজ। কদ্দিন শিখছেন কে জানে। এর জন্য একশো টাকা? বোগাস।”
চড়া রোদে মেয়েটার মুখে ছায়া নামে, “ভাল লাগেনি আপনার? আমি আবার এঁকে দেব?”
আমি সুতো ছাড়ি, “ঐ ছবিটি কার? ওটা আপনারই আঁকা তো? নাকি?” ঠোঁটে-মুখে-চোখে তাচ্ছিল্য মাখি আমি।
কাণ্ড বোঝ! মেয়েটি পেইন্টিংটার দিকে তাকিয়ে আছে তো আছেই। তোর চোখ আমি খুঁচিয়ে দেব, মেয়ে।
“ওটা বিক্রি নেই।”
“কেন? মাঠে নাচতে নেমে…” আমি থেমে যাই, “ওটা আমি কিনব।”
“সরি, ম্যাডাম, ওটা বিক্রি হয়ে গেছে।”
“মিথ্যে কথা। তাহলে আপনি গুটিয়ে রাখতেন।”
লোকালিটিতে ঝগড়ুটে বলে আমার একটা নাম আছে। হুহু বাওয়া। অতঃপর – মিনিট পনের পার, বেশ কিছু লোকের ঘিরে ধরা, গায়ে পড়া সাপোর্টার জুটে যাওয়া, রোদ আরও চড়চড়িয়ে বেড়ে যাওয়া আর আমার পাঁচশো টাকার দুটো নোট মেয়েটার মুখের সামনে ঝুলিয়ে দেওয়া – সব এপিসোড পার হয়ে গেলে আমি বিজয়গর্বে দুটো ছবিকে রোল করে পাকিয়ে এগোই, মেয়েটার দিকে আর তাকাই না।
“নাইস জব। এক্সেলেন্ট আর্ট।”
এক ঘণ্টা কেটে গেছে। কিছু বই কিনেছি। শামি কাবাব খেয়েছি। এবার একটু ফাঁকা জায়গা পেয়ে সমুদার ছবিটাকে বুকের কাছাকাছি রেখে নিজের ছবিটা ঘাসের উপরে মেলে ধরেছি আর অমনিই যেন ঠিক সেই সময়েই সেই ছেলেটাকে পাশে এসে দাঁড়াতে হবে আর অমন মন্তব্যটি পেশ করতেই হবে। কোনও মানে হয়? কী বলব ভেবে ওঠার আগেই সে লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটা লাগিয়েছে আর আমি? আমার ছবি, জলের বোতল, সদ্য কেনা বই, বুকে ধরা সমুদার ছবি, ‘শুনছেন, একটু দাঁড়ান’ জাতীয় ডায়লগ থ্রো – সব মিলিয়ে মিশিয়ে জট পাকিয়ে বসেই রইলাম।
পেলাম। দেখা তার আবার পেলাম। লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়নের পেছনের ছোট্ট ঘাসে ঢাকা জায়গাটায়। বেশ কিছু ছেলে-মেয়ে পরিবৃত হয়ে। বাকিরা গাইছে হাততালি দিয়ে আর ছেলেটা বাজাচ্ছে গিটার। এক সময় গান থেমে গেল। বাজনা চলল। আমি গিটার বুঝি না, আমি সিন্ধুসভ্যতার পতনের কারণও বুঝি না। শুধু বুঝি সেই সময়টুকু একটা থমকে যাওয়া কালপ্রস্তরখণ্ড। আমি চাইছিলাম না সেই কালপ্রস্তরখণ্ড ভেঙে যাক। কিন্তু গেল। হাততালি দিয়ে উঠল ওর বন্ধুরা আর চারদিকের দাঁড়িয়ে থাকা লোকজন। আমিও দিলাম আর দিল সেই মেয়েটি। ও তার সমুদার কাছটি ঘেঁষেই বসেছিল। ওর সমুদা ওর দিকে চেয়ে অল্প হাসল। আমি দেখলাম। আর সমুদা নয়, ঐ মেয়েটিকেই যেন আরও উৎসাহিত করবার জন্য, আরও জোরে হাততালি দিলাম, দিতেই থাকলাম।
-----
Tags:
গল্প