অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়

দিল্লির কবি জাফর জাটাল্লি

অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়


শাহজাহানাবাদে চাঁদনী চৌকের চবুতরা জুড়ে সেদিন বিশাল ভিড়। মুশায়রা বসবে। শাহি দরবারের জমকালো মুশায়েরা নয়, শহরের সাধারণ লোকের মুশায়রা। আসর জমাতে আসছেন এই শহরের খ্যাতনামা কবি, মহম্মদ জাফর জাটাল্লি। তাঁর শাগিরদ কিছু কম নয় এই শহরে। জাটাল্লি হচ্ছে কবির তাখল্লুস, বা ছদ্মনাম। জাফর তাঁর ছদ্মনামের আড়ালে নিজেকে বেবাকুফ বলে পরিচয় দেন। আসলে তিনি একজন ক্ষুরধার কবি, যার কবিতার ঘায়ে মূর্ছা যায় এই শহরের আমীর ওমরাহ্‌ থেকে শুরু করে, পথচলতি ভবঘুরেও।

ওস্তাদ জাফর জাটাল্লির কিছু চেলা আছে, তারা মুশায়েরাতে যোগ দেবে বলে অপেক্ষা করছে। জাটাল্লির স্বভাব এমনি যে কোনও সভায় দেরি করে না এলে তার মান থাকে না। মুশায়েরার সভায় ফরাস পেতে তাঁর উপর তিনটি গোল তাকিয়া রাখা আছে। জাটাল্লি সেখানে এসে বসবেন।

সন্ধ্যে নামতে এখনো কিছু দেরি আছে। শহরের বাতাসে এখন ফুলের গন্ধ ভাসে। তদারকির অভাবে চাঁদনী চৌকের ফোয়ারা বহুকাল বন্ধ। কিন্তু জাহানারা বেগমের তত্ত্বাবধানে লাগানো ফুলের গাছগুলো এখনো অক্ষত রাস্তার দুই পাশে। ফুলের গন্ধের সাথে মিশে যাচ্ছে কাবাবের খুশবু। কাবাবের দোকান আগে কখনো চাঁদনী চৌকে ছিল না। আভিজাতদের জন্য খোলা হয়েছিল দোকানপাট। এখন পেটের তাগিদে কিছু ওস্তাদ কারিগর গোস্ত আর কাবাবের দোকান খুলেছে চাঁদনী চৌকের রাস্তার পাশে। খদ্দেরের অভাব নেই এই শহরে, কারণ এই শহরের জন্মের পর থেকে প্রায় ছয় দশক কাটিয়ে আজ মানুষ বেড়ে গিয়েছে অনেকগুণ। খুলে গিয়ে গিয়েছে পান আর হুক্কার দোকান। মুশায়েরার সাথে সাথে আজ যাবতীয় দ্রব্য বিকোবে ভালই।

আসর ঘিরে জমে ওঠা ভিড়ের মধ্যে আছে কিছু তস্কর। মানুষের অসাবধানের সুযোগ বুঝে কোঁচড়ে রাখা মুদ্রা হাতসাফাই করতে তাদের জুড়ি নেই। সভায় একজন ঢোলক বাদক আছে, যার কাজই হচ্ছে মাঝে মাঝে ঢোল বাজিয়ে লোক জড়ো করা।

জাটাল্লি আজকাল এই ধরণের মুশায়েরাতে ডাক পান ঘনঘন। এটাই তাঁর পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কবিতা শুনে খুশি হয়ে মানুষ দাম কিম্বা আসরফি ছুঁড়ে দেয় সামনে রাখা চাদরের উপর। সেসব দাতার পকেটের ওজনের উপর নির্ভর করে। মুশায়েরার মোট রোজগারের তিন চতুর্থাংশ জাফর জাটাল্লির, বাকি উদ্যোক্তাদের। এই সোজা হিসেব মেনে নিলে যে কোনও মুশায়েরাতে তাঁকে পাওয়া সহজ কাজ।

ভিড়ের মধ্যে একটা গুঞ্জন উঠল। ঢোলক বাদক জোরে জোরে ঢোল বাজাতে লাগল। একজন দাঁড়িয়ে পড়ে মহম্মদ জাফর জাটাল্লির আগমনবার্তা ঘোষণা করল, ঠিক যেমন করে কেল্লার দিওয়ানি আম-এ বাদশাহর আগমন ঘোষিত হয়। দেখা গেল, ত্রস্ত পায়ে একজন বৃদ্ধ ফরাসের উপর উঠে এলেন। তাঁর পরনে সবুজ সিল্কের জোব্বা, মাথায় মেরুন রঙের পাগড়ি। সাদা দাড়িতে ঢাকা কঠিন চোয়াল। চোখদুটো ধূর্ত। বৃদ্ধ হলেও তাঁর শরীর বেশ মজুবুত। একসময়ে নাকি তিনি পালয়ানি করতেন। ইনিই হচ্ছেন স্বভাবকবি জাফর জাটাল্লি।

“মহম্মদ জাফর জাটাল্লি সালামত রহে”, ধ্বনি উঠল সভায়। শোরগোল থামাতে জাটাল্লি একটা হাত তুলে সবাইকে নিবৃত্ত করলেন। কে একজন তামাশা করে জাটাল্লির দেরিতে আসার কারণ জিজ্ঞেস করতে তিনি শায়েরিতে শোনালেন, যেহেতু সারাজীবন অবিবাহিত থেকে বৃদ্ধ বয়সে পৌঁছে তিনি একসাথে দুই দুইটি তরুণীকে নিকাহ করেছেন এবং তাদের সামলাতে সামলাতে তাঁর রাত কেটে যায় অনিদ্রায়, তাই তিনি কিছুটা দেরিতেই ঘুম থেকে উঠে থাকেন আজকাল।

সভার লোকে কবির চটুল রসিকতা শুনে অশ্লীল শব্দ প্রয়োগ করতে শুরু করল। জাটাল্লির পাশে এক তরুণ জাবদা খাতা নিয়ে বসল। আজ তিনি যা শোনাবেন, সে সব লিখে রাখবে। জাটাল্লির দুয়েকটা কিতাব ছিল বাজারে। বর্তমান সম্রাট ফারুকশিয়রের নির্দেশে সব নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। দোকানে দোকানে ঢুকে শাহি সৈন্যেরা সেই কিতাব খুঁজে বার করে পুড়িয়ে দিয়েছে প্রকাশ্যে। তবু জাটাল্লিকে রোখা যায়নি। তাঁর লেখা বই “গান্ডুনামা” অশ্লীল বলে কিছুদিন আগেই পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এই শহরে। তবে এখনো চৌড়ি বাজারে তবায়েফদের আসরে সেই সব কবিতা খুবই জনপ্রিয়। সেই কিতাবে শাহি পরিবারের উচ্চ মহলের পুরুষদের সমকামিতা নিয়ে প্রবল বিদ্রূপ করে বিরাগভাজন হয়েছেন জাটাল্লি। এমনকি প্রয়াত শাহেনশাহ বাহাদুর শাহ্‌কে ছেড়ে কথা বলেননি তিনি।

অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করলেও জাটাল্লির কাব্যে যাদু আছে। সেই যাদুর টানে অসংখ্য ভক্ত তাঁর। প্রয়াত সম্রাট জাহান্দার শাহ্‌ জাটাল্লির কবিতার একজন বোদ্ধা ছিলেন। অভিজাতরা বলত- যেমন শাহ্‌, তেমনি তাঁর শায়ের। যদিও সভাকবি হওয়া জাটাল্লির পক্ষে অসম্ভব ছিল। খুব গোপন কোনও শাহি পানভোজনের মজলিসে দুএকবার তিনি গিয়েছেন ঠিকই। কিন্তু জাহান্দার শাহ্‌র অপশাসনের বিরুদ্ধে চলেছে তাঁর কলম। কাজেই কেল্লা থেকে বার করে দেওয়া হয়েছিল জাটাল্লিকে।



দুই অশ্বারোহী প্রহরী চাঁদনী চৌকের ভিড়ের দিকে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে সেখানে কী চলছে। জবাবে তারাও আগ্রহী হয়ে ঘোড়া বেঁধে রেখে আসরে এসে বসে। প্রহরীদের দেখে তস্করেরা অন্যের জেব খালি করতে বিশেষ সাহস করে না। শাহি শাসনে এই সৈন্যেরাও খুশি নয়। নিয়মিত মাসহারা তারা পায় না। আগে তারা মেওয়াতে চাষআবাদ করে সংসার চালাত। ফসল ফলিয়ে রোজগার হয় না। মনসবদারের খাজনা আদায়ের দাবি বেড়েই চলে। পেটের টান তাদের ঘরছাড়া করল। তারও জানে, মুশায়েরাতে ভিড় করে আসা প্রতিটি মানুষের জীবনের গল্পও প্রায় একই।

জাটাল্লি শোনান, আগে মুঘল শাসনে কেমন সুন্দর দিন কেটে যেত মানুষের। আর এখন? দুর্বল সম্রাট বন্দী ক্রূর আমীরদের হাতে। শাহজাহানের স্বপ্নের শহর এখন যেন জীনে পাওয়া হত দরিদ্র এক নগরী, যেখানে দুই বেলা খেতে পাওয়া আজ বিলাসিতা। জাটাল্লির অশ্লীল শব্দে ভরা কাব্যে মজা পায় মানুষ। কিছুক্ষণের জন্য যেন জ্বালাযন্ত্রণা ভুলে থাকে তারা। একজন শীর্ণকায় তরুণ তার সাথীকে বলে, “ভাষাটাই শুধু খারাপ। ছন্দের ব্যবহার দেখেছ? তীব্র শ্লেষের কী অপূর্ব ব্যবহার!”

এই কথা শুনে ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি জানায় তরুণের সাথী। বলে, “বিদ্রোহের আর এক নাম জাটাল্লি। কিছুই তো অবশিষ্ট নেই সেই সুনেহরা দিনগুলোর। এখন সব অতীত, শুধু রক্ত শুষে চলেছে মাটি।”

একজন সূফীদের মতো দেখতে বৃদ্ধ এতক্ষণ দুই তরুণের কথা শুনছিল। মুখের উপর থেকে দোপাট্টা নাড়িয়ে মাছি তাড়াতে তাড়াতে সে আপত্তি জানায়, “না হে, এই শহরে হজরত আমীর খুসরো পথ চলতি মানুষকে বলতেন মুখের ভাষা সংযত করতে। তবে হ্যাঁ, অশ্লীল শব্দের এত প্রয়োগ না করলে লোকটা এতদিনে শাহি দরবারে পৌঁছে যেত ঠিক।”

“আর তখনি আর দশটা সাদামাটা শায়েরের সাথে তার আর কোনও তফাত থাকত না জনাব!”, সপাট জবাব দেয় তরুণ।

“ঔর একবার, একবার ঔর ওস্তাদ! বিসমিল্লাহ্‌! কেয়া লিখা হ্যায় আপনে!” বলেই এক মুঠো দাম ছুঁড়ে দেয় একজন সভ্রান্ত চেহারার মানুষ। একটা দাম হাত বাড়িয়ে কুড়িয়ে নেয় এক ভিখিরি। তা দেখতে পেয়ে একটা হট্টগোল বেধে যায় আসরে। ডাণ্ডা হাতে উঠে দাঁড়ায় প্রহরী। চুপ করায় সবাইকে। জাটাল্লি বলেন, “সিক্কা জাদ বার গান্দুম ও মথ ও মটর, বাদশাহ ই দানাকশ ফারুকশিয়র।”

আসরে ধন্য ধন্য করে ওঠে সবাই। একজন অবুঝ দূর দেশ থেকে এসেছে কাজের তল্লাসে। সে কিছু বুঝে উঠতে না পেরে ভদ্র পোশাকের এক মানুষকে মিনতি করে, “যদি একটু বলে দেন, উনি কী বললেন…।”

ভদ্র লোকটি শান্ত গলায় বলে, “এর অর্থ অতি গভীর! চাল-গম আর মটর দিয়ে বানাও তোমার মুদ্রা যত। বাদশাহ বটে ফারুকশিয়র কুড়ায় ফসল অবিরত।”

“কিছু বোঝা গেল না? তাহলে শোন, হিন্দুস্তানের বাদশাহ ফারুকশিয়র শাহেনশাহ হয়ে মুদ্রা বানালেন। তাতে খোদাই করে লিখে দিলেন – সিক্কা জাদ, আজ্‌ ফজল ই হক্‌, বার সিম ও জার্‌, বাদশাহ ই বাহার ও বার, ফারুকশিয়র। মানে হচ্ছে- পয়গম্বরের ইচ্ছেয় আজ সোনা আর চাঁদি দিয়া, গড়ে মুদ্রা জলস্থলের বাদশাহ সে ফারুকশিয়র।”

আগন্তুক এবার হেসে ফেলে বলে, “বুঝলাম মিয়াঁ। আজ ফারুকশিয়রের দেশে সোনা চাঁদির বড়ই অভাব। সব লুটে পুটে খাচ্ছে সৈয়দ ভাইদুইজন আর তাদের খোশামদকারীরা। শাহেনশাহ তাই বানাচ্ছেন চালডাল আর মটর দিয়ে শাহি মুদ্রা। দেশের লোক তাহলে সেইসব খেয়ে বেঁচে থাকতে পারবে। কিন্তু জাটাল্লির এই কটূক্তি ফারুকশিয়রের কানে গেলে তো বিপর্যয় হবে!”

“হ্যাঁ গুপ্তচরেরা এতক্ষণে হয়ত তার কানেও তুলেছে সেসব কথা। চলো, যাবার রাস্তা দাও। কী দরকার ঝক্কি সামালাবার। এখন তো প্রতিদিন রাস্তায় রাস্তায় চলছে অকারণ হত্যালীলা। হয়ত আরও একটা হবে। কে বলতে পারে?”

সম্ভ্রান্ত লোকটা ভিড়ের মধ্যে থেকে উঠে চলে যায় আসর ছেড়ে। জাফর জাটাল্লির রসিকতা তখন তুঙ্গে। চতুর্দিক থেকে উঠছে করতালি, অশ্লীল কটূক্তি, আওয়াজ।



শাহি পরোয়ানা রটে গেল শহরের রাস্তায় রাস্তায়, প্রতিটি কুচা আর কাটরায়। চাঁদনী চৌকের রাস্তায় মানুষের ঢল নামল। কোতোয়ালি চবুতরাতে দুটো বিরাট বাঁশের খাম্বা গেড়ে দেওয়া হয়েছে। উপর থেকে ঝুলছে একটা মোটা দড়ি, তাতে ফাঁস লাগানো। কোতোয়াল ব্যস্তসমস্ত হয়ে ধমক ধামক দিচ্ছে তার সহকারীদের। চোখের কোল মুছতে মুছতে আফগান সৈন্যদের ধাক্কা খাচ্ছে বাজারি যত মানুষের দল। তাদের বড় কাছের মানুষ একজন আজ ওই তখতে ঝুলবেন। তবু তারা তাঁকে শেষ দেখা দেখবে বলে পরস্পরের কাঁধে ভর দিয়ে তাকিয়ে আছে চবুতরার দিকে।

অবনত মস্তকে দৃপ্ত পদভঙ্গীতে পিছমোড়া অবস্থায় এলেন মহম্মদ জাফর জাটাল্লি। তার দুই জেনানির মুখে আজ আব্রু নেই। তারা আছাড়ি পিছাড়ি কাঁদতে কাঁদতে চলেছে নগর কোতোয়ালের বাহিনীর পিছন পিছন। কিতাবের দোকানের মালিক তার দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করতে করতে বলে, “বহুত ন ইন্সাফি! না কাজীর সামনে বিচার হল, না কেউ তার পক্ষে কিছু বলল। এ কেমন দেশে বাস করছি আমরা? ব্যস, কাউকে ধরে এনে চবুতরাতে ঝুলিয়ে দিলেই হল? মড়ক লাগবে এই শহরে!”

মহম্মদ জাফর জাটাল্লির ফাঁসি দিল জল্লাদ। তাঁর নিষ্প্রাণ দেহ চাঁদনী চৌকে প্রকাশ্যে ঝুলে রইল তিনদিন। তারপর আবার মুদ্দাফরাশ এসে লাশ নিয়ে যেতেই সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে গেল শহরে। শহর কোনও ঘটনাই মনে রাখতে পারে না বেশিদিন।