অমিত গোস্বামী

পীযূষকান্তি, পঞ্চাশে পা

অমিত গোস্বামী



কবি পীযুষকান্তি বিশ্বাসের সাথে আমার আলাপ ফেসবুকে এবং ঘটনাক্রমে চাক্ষুস আলাপ দিল্লিতে। এই মানুষটি বয়েসে আমার অনুজ। বেশ মনে আছে যে আমি প্রথম আলাপে বলেছিলাম – আমি কিন্তু আপনার কবিতা পড়ি, বেশ ভাল লাগে। সামান্য ভ্রু কুঁচকে বলেছিলেন – কোন কবিতাটা বেশ ভাল লেগেছে? কবিদের প্রশংসা করলে সাধারণত তারা ধন্য হন। বিরাট বিরাট ধন্যবাদ দেন। উলটো প্রশ্ন খুব কম মানুষই করেন। বললাম - মানুষ তো আসলে ঘরে আসে না-/কিংবা যায়ও না শুধুই ঘর বানায়/আর রাত যাপনের দিন পার করে.../দিনের বনসাই হয়ে বেঁচে থাকে/অথচ চাঁদরাই প্রথম প্রজ্ঞাল পাঠালো কালোছায়ার নীল বর্ণজলে… তিনি কিছুটা প্রশ্রয়ের দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। তারপর থেকে তার সাথে আমার আত্মীয়তা কবিতায়।

তার আরেকটি কবিতার লাইন আমার চেতনায় মুহুর্মুহু ঢেউ তোলে। যে সব ফল ফলেছে আমার বয়ঃসন্ধির দিনে/ হাত চাটতে গিয়ে যেদিন প্রথম আঙুল কামড়ালাম/ নখ থেকে ছুটে গেলো হাফ ব্যাক/ বল ছুটে গেলে দেখি দুয়ারে পা চেপে ধরে/ বেবাক তাকিয়ে আছে ঘর বারান্দা … নৈরাশ্যবোধ, হতাশা, ক্লিষ্টতাময় জীবনের দৃশ্যমান অভিজ্ঞতা এ কবির কবিতায় সঙ্কটের সত্যমৌলিকতাকে বিকাশ ঘটায়। অস্তিত্ব সংসারবেদনা অপ্রাপ্তিবোধ মানুষের জীবন স্পন্দনকে নির্বিকারচিত্তে বিমূর্তের জাগরণ ঘটায়।

জীবনযাপনের স্থূলতা, ঐতিহ্যের পর স্পর্শকে অস্বীকার করে নিজের জীবনযাপনের পথকে বৃত্তাবদ্ধ করে মনোজগতে স্থির নয় তবে মিশ্র স্থিরতায় রক্তীয় বীজের জাগরণ আমাদের হতাশা আর নৈরাশ্যপ্রবণ বা ক্রমশ আবেগপ্রবণহীন ভিন্ন মানুষ রূপে রূপান্তরিত করে, যা কিনা অস্থিত্ব সঙ্কটের এক দুঃখের তীব্র যন্ত্রণাবোধকে প্রাণিত করে তোলে। কবি সেই দুঃখ আর নৈরাশ্যবোধের চেতনা থেকেই একটি ইংরেজি কবিতা লেখেন -— Rajesh Khanna who will be in Karnataka / in form of journals/ it turns into warning,/manuscript are then crystalized / into diamond

পীযুষ নদীয়ার মানুষ। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে বিমানবাহিনী হয়ে ব্যাঙ্গালোর হয়ে দিল্লি। এই কবির অনেক কথা আমার সহজে বোধগম্য হয়। তাকে আমি অনুভব করতে পারি। তার কবিতাকে স্পর্শ করতে পাবি। তার আবেগকে ছুঁতে পারি। তার কবিতায় দেখি - বন্ধ দুচোখের পাতায় এতটা শিশির ঘোষ ছিলো,/ টেলিভিশন থেকে বেরিয়ে আসা ক্যাথোড রে/ উফ আমার নাসপাতির বাগান ছারখার করে/ জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে কোনোদিন তো এত বিদ্ধ হইনি...

‘ঘুমঘর’ ও ‘আকাশচুম্বল’ এ দুটো কবিতা সংকলনই সাক্ষ্য দেবে পীযূষের বিরামহীন নিরীক্ষালগ্নতা। এ নিরীক্ষা যেমন ভাষাকাঠামোর তেমনি আঙ্গিক সংস্থানেরও। আর তাত্পর্যের দিক হচ্ছে আধুনিক কবিতা নিয়ে জনযোগাযোগহীনতার যে অভিযোগ তা থেকেও তার কবিতা আশ্চর্যরকমভাবে মুক্ত।

কেন তার কবিতা এত মনোগ্রাহী? এককথায় বলা যায় তার অধিকাংশ কবিতার অবয়ব ছোট। শব্দের ব্যবহারজনিত সংযম ও কৃপণতা এবং স্পেস ও সাংকেতিকতা, পরিহাস ও স্যাটায়ার সহযোগে কবিতার ভাষা উত্তরাধুনিক কবিতার মতো অনেক বেশি তীর্যক যা আমরা অন্যদের কবিতায় পাই না। তিনি ফতোয়াকে আক্রমণ করেছেন কিন্তু তাকে অস্বীকার করেননি। তিনি পরিমিতিবোধের কবি, স্মিতবাক কবি, ভদ্রগোছের কবি। তাঁর মুগ্ধতার ভাষা অনুদ্বেলিত, তাঁর ঘৃণার ভাষা সুপরিশীলিত; তাঁর প্রতিবাদের ভাষা বিদ্বেষমুক্ত, তাঁর প্রেমের ভাষা পরিণত। সব ক্ষেত্রেই তিনি আবেগের আতিশয্য এবং উচ্চারণের প্রগলভতাকে পরিহার করেছেন। তিনি কল্পনাকেও কখনো লাগামহীন হতে দেননি। উদার মানবতাবাদে গভীরভাবে বিশ্বাসী কবি। তাঁর কবিতায় মানবতবাদী সুর প্রবল, তবে তা প্রগলভ নয়। আধুনিক কবি হয়েও তিনি শিল্পের বিমানবিকীকরণ তত্ত্বে গা ভাসিয়ে দেননি।

নিঃসর্গ তাকে মুগ্ধতা দেয়, কিন্তু নৈসর্গিকতাকে তিনি কখনো বান্ময় করে তোলেন মানব জৈবিকতার লীলার প্রেক্ষিত হিসেবেও। নৈসর্গিক ও মানবিক হয়ে ওঠে সমন্বয়ী ও সংশ্লেষিত। তিনি লিখছেন – যা কিছু রুলার ছিলো, ছোট পড়ে যায় বলে/ আমি কিছু শূন্য একেট্টা করি,/ দাগ দাগ আঙুলগুলো সাজিয়ে/ গদগদ ইশারা করি প্রতিবেশীনিকে,/ আজ ঠিক দেখো চাঁদনী আর/ এক কোয়ার্টার লাক্স/ মোলায়েম করে তুলবে অন্ধকারকে ।

এক আলোচনায় তিনি বলেছিলেন - সাহিত্যের একটা লিটারেরি প্রপার্টি বা সাহিত্যমূল্য আছে। লেখাটি যখন শুধু লেখামাত্রই থাকে, তখন সেটার কোনো মূল্য নেই। এটা একটা বর্ণনা হতে পারে, অন্তর্গত বোধ হতে পারে। কিন্তু লেখার ভেতর যখন সাহিত্য মূল্যটা থাকবে, তখন এটাকে আমি বলব, এটা শিল্প হয়ে উঠেছে; কবিতা হয়েছে। একজন কবির কাজ অন্বেষণ করা, আবিষ্কার করা নয়। তার ভেতরে সবসময় অতৃপ্তি ও অন্বেষণ করার তাগিদ থাকে। মননশীলতা ও সৃজনশীলতার সমন্বয়ে কবিতা রচনা করে সে।

এখানকার পাঠকরা প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে বলশালী। বর্তমানে ইন্টারনেটের সৌজন্যে দুধ কা দুধ পানি কা পানি সহজেই বোঝা যায়। সে জন্যে আমরা তাকিয়ে থাকি তার কবিতা দর্শনের অপেক্ষায়। তার আগত পঞ্চাশে পীযূষ দিবসে তাই প্রার্থনা একটাই, ভাল থাকুন, তাহলেই আমরা ভাল লেখা পাবো।