তুষ্টি ভট্টাচার্য

তারপর

তুষ্টি ভট্টাচার্য


 




১)

তারপর?
তারপর নীহারিকা থেকে এক জ্যোতিঃপুঞ্জ
নেমে এলো তার সামনে।
সেই তেজঃরাশি ধীরে ধীরে রূপ নিল
এক সুপুরুষ দেবতার, নাকি মানবের?
তিনি অভয় দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,
‘কী বর চাও তুমি বল’

তারপর?
তারপরের কাহিনি উন্মোচিত হওয়ার আগেই
শেষ হয়ে এলো জীবনের উপরেখাসমূহ।
নির্জন এক কালো নদীর তীরে দাঁড়িয়ে রইল সে
‘ভবনদী কি এইরকম দেখতে?’
এইই কি কাহিনির মুখ্য রূপ তবে!
তারপর?
তারপর এক উদাস হাওয়ার দিকবদল হতে দেখা গেল।



২)

তারপর যেতে যেতে দেখা হয়ে যায় যাদের সঙ্গে
তাদের সঙ্গে এজীবনে দেখা হওয়ার কোনও কথা ছিল না।
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন কোনও দ্বিধার গলাধঃকরণে
তারা দিব্যি একে অপরের পাশ কাটিয়ে চলে গেছে।

তারপর?
এ সমস্তের অনুরূপ ঘাত ও প্রতিঘাতের থেকে দূরে
বয়ে চলেছে আলো। আলোর মুখে মুখ রেখে চুমু খেয়ে যায়
অন্য আলোর অবয়ব, ছায়াহীন প্রেতাত্মার মতো নিশাচর সে
কাহিনির কাছে সম্পর্করহিত এই আলোর ভাষা কেউ কি চিনেছে?
কোথাও কেউ নেই এখানে
‘এখানে কেউ থাকে না’

লিখে দিয়ে গেছে কেউ কালো কালিতে


৩)

তুমি নির্ভার, তুমি উড়ন্ত ঢেউ
তুমি সারসপ্রেমী তরুণ তমাল
তুমিই সেই, সেই অগতির গতি
ঢেউ দিয়ে গেছ বারবার,
তারপর কোথা থেকে যেন উড়ে এসেছে ওরা
ওদের অগ্ন্যুৎপাত এই আকাশে আঁক কাটতেও পারেনি!

তারপর?
নখর বিনাশ কর হে!
আমূল উৎপাটন হোক সর্বনাশ
হোক বিলাসকুসুম মনোরঞ্জন!
হোক মাধুকরী, ভাণ্ড উপচে পড়া সুখ
আমি সেই সুখে ঈর্ষার চোনা ফেলে যাব।



৪)

তারপর এলো অবিনাশ
তারপর এলেন তথাগত
তিমিরনাশিনী কালিকা আর জীমূতবাহন
পাদপদ্মে নিবেদন করি নিজ অহং
আমি খুঁজে ফিরি সেই ব্যাঘ্রচর্ম
যাকে পৃষ্ঠে বেঁধে চলে গেছেন তুত্তেরি তারা!

হলুদ বরণ তার, কালো ডুরে শাড়ি মেঘবালিকা
শ্যামল বরণ গাই তার, ডুবেছে কোন দহে!
তারপরে ওরা হারিয়ে যেতে চেয়েছে সেই নীলাকাশে
যেখানে আজও নিরুত্তাপ খেলা করে
ছায়ার আদল, মেঘের কালিমা, ঝঞ্ঝার স্বরূপ।

আমি চেয়ে থাকি নীলে, সুদূরের দিকে
তারও পরের কাহিনির অনাঘ্রাণে
মন বিবশ হয়, ভালো তো লাগে না আর!



৫)

সুন্দরীতমা তুমি
মনোলোভা দেহের আদল ফুটে উঠেছে
নদীর আবেশে। বিবশ হয়ে দেখি
দেখি পুষ্পহার, কটিবন্ধনী, নিবিড় নাভি
মনে পড়ে শকুন্তলা? অঙ্গুরিয় কাহিনি?
আঁটোসাঁটো বক্ষবন্ধনী শিথিল করেছিলে
কোন অভিশাপে? ছলনা শেখনি?
বালিকা তুমি, মূঢ় মতি, চপল স্বভাব
ঘাই হরিণীর চঞ্চলতায় আবিষ্ট হও!

মৎস প্রজাতি সুজন তোমার
সযত্নে রক্ষা করেছিল পরিচিতি
হারিয়ে ফেলেছিলে যা, নিজস্বতার অবক্ষয়
ছিল বুঝি! সন্তান কোলে তুমি মাতৃপ্রতিমা
বোকাহাঁদা মেয়েছেলে! খেদিয়ে দিয়েছে ওরা
তারপর?
একক মাতৃত্বের সংজ্ঞা শিখেছিল ওরা
দূর থেকে তোমাকে দেখেছিল সম্ভ্রমে, শ্রদ্ধায়
হারিয়ে গেছিল সরল বালিকার সকল বিস্ময়।



৬)

আমি শিখিপাখা, আমি নিশাচর
আমি অজস্র বক, অগুণিত ঢেউ।
তুমি শেষনাগ, অনন্ত হ্রেষা,
সারিবদ্ধ মেঘ। বৃষ্টি আমি
আমিই সেই সোঁদা ঘ্রাণ…
তারপরেও নিয়তির পরিহাসে
আমাদের আত্মরতি বৃথা যায়
বয়ে চলে বসুধা, অযৌন সংসর্গে
স্বর্গবাস! নিহত হয়েছিল শর।


আঁখি মেল ওহে, দিবাস্বপ্নে তুমি রোজই
দেখে চলেছ একই স্বপ্নের পুনরাভিনয়
নিহিত হয়ো না! বিনাশ কর শোকতাপ
আত্মদর্শনে এসো তবে! আয়না, ওগো আয়নামতি
তরল হও আজ। নেহাতই হেসেখেলে চলে চল
ওই দেশে, যেখানে আজও ঘুরেফিরে আসে
দিন ও রাত, রাত ও দিনের ছেলেখেলা।