মিনতি ভট্টাচার্য

স্মৃতির সরণি বেয়ে মহাবীর এনক্লেভ

মিনতি ভট্টাচার্য




সময় নদীর মতো, বয়ে চলে নিরন্তর, রেখে যায় তার চলার পথে অজস্র স্মৃতির চিহ্ন – কিছু উজ্জ্বল, কিছু ম্লান। আজ যখন স্মৃতির অতল গভীরে ডুব দিই, কত মুখ, কত ঘটনা ভেসে ওঠে চোখের সামনে। সেইসব উজ্জ্বল মুখের ভিড়ে একটি মুখ বিশেষভাবে মনে পড়ে – সে আমার স্নেহাস্পদ তরুণ কবি, পীযূষকান্তি বিশ্বাস। এই লেখা কেবল তাকে ঘিরে নয়, এ হলো আমাদের সময়ের দলিল, দিল্লির বুকে এক টুকরো বাংলার প্রতিচ্ছবি – আমাদের প্রিয় মহাবীর এনক্লেভ – আর সেখানকার সাহিত্য-সংস্কৃতির স্রোতে পীযূষের মিশে যাওয়া ও এগিয়ে চলার কাহিনি। দেখতে দেখতে পীযূষ জীবনের পঞ্চাশতম বসন্তে পা রাখলো। এই শুভক্ষণে তার জন্য রইলো আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা, ভালোবাসা আর অফুরান আশীর্বাদ।
 

সালটা সম্ভবত ২০০৬ অথবা ২০০৭। দিল্লির বুকে প্রবাসী বাঙালিদের অন্যতম পরিচিত ঠিকানা, আমাদের মহাবীর এনক্লেভ, তখন বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার এক প্রাণবন্ত কেন্দ্র। আমরা কয়েকজন সাহিত্যপ্রেমী মানুষ মিলে নিয়মিত বাংলা সাহিত্য আসরের আয়োজন করতাম, নিজেদের শিকড়কে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে। আমাদের এই প্রয়াসের মুখপত্র ছিল 'কথাঞ্জলি' নামের একটি লিটল ম্যাগাজিন, যার সুদক্ষ সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন শ্রদ্ধেয় দিলীপ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। এই উষ্ণ, আন্তরিক সাহিত্যিক পরিমণ্ডলেই একদিন এসে উপস্থিত হলো বছর তিরিশের এক তরুণ। চোখেমুখে ছিল কিছুটা সলজ্জ ভাব, কিন্তু তার কথাবার্তায় প্রকাশ পেল বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি এক গভীর ভালোবাসা ও টান। জানালো, সে এই পাড়াতেই সদ্য ঘর ভাড়া নিয়েছে এবং আমাদের এই বাংলা চর্চার মহৎ উদ্যোগের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করতে চায়। এই তরুণই হলো পীযূষকান্তি বিশ্বাস।

তার সারল্য, তার আন্তরিক ব্যবহার আর সর্বোপরি বাংলা ভাষার প্রতি তার এই অকৃত্রিম অনুরাগ আমাদের সকলের মন জয় করে নিল। আমরা তাকে অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে আমাদের সাহিত্য পরিবারে আপন করে নিলাম। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পীযূষ কেবল একজন শ্রোতা বা পাঠক হয়ে রইলো না, সে হয়ে উঠলো আমাদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তারুণ্যের উদ্যম নিয়ে সে ঝাঁপিয়ে পড়ল আমাদের সাথে। আজও মনে পড়ে, 'কথাঞ্জলি' পত্রিকার কোষাধক্ষ্যের গুরুদায়িত্ব সে অত্যন্ত নিষ্ঠা ও স্বচ্ছতার সঙ্গে বহু বছর ধরে পালন করেছিল। তার যোগদান আমাদের সাহিত্য আসরে এক নতুন প্রাণের সঞ্চার করেছিল, যেখানে প্রবীণের অভিজ্ঞতা আর নবীনের উদ্যম মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল।

 
পীযূষের কথা বলতে গেলে, যে প্রেক্ষাপটে তার আগমন, সেই মহাবীর এনক্লেভের উত্থানের গল্পটা না বললেই নয়। দিল্লির দক্ষিণ-পশ্চিম জেলার অন্তর্গত পালাম বিমানবন্দর সংলগ্ন এই কলোনিটি আশির দশকে ছিল এক সম্ভাবনাময় স্বপ্নভূমি। আমার স্মৃতিতে ভেসে ওঠে ১৯৮০ সালের সেই দিনগুলো। আমি তখন নানকপুরায় সরকারি আবাসনে থাকি, কিন্তু মনে মনে নিজের একটা বাড়ির স্বপ্ন দেখি। সেই স্বপ্নপূরণের আশায় প্রথম জমি দেখতে এসেছিলাম এই মহাবীর এনক্লেভে। ৭৮১ নম্বর বাসে চেপে পালাম গাঁও নেমেছিলাম। সেখান থেকে গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য আর কোনও নিয়মিত বাস পরিষেবা ছিল না, কেবল ৮০১ নম্বর বাস সারাদিনে হাতে গোনা তিন-চারবার করমপুরা টেকনিক্যাল পর্যন্ত যাতায়াত করত। তাই ভরসা ছিল নিজের দু'পা।

হেঁটে চলেছি তো চলেছি। যতদূর চোখ যায়, কেবল ধু ধু করছে গমের ক্ষেত। আজকের যে এলাকাকে আমরা ই-ব্লক নামে চিনি, সেখানে তখন ছিল এক শিখ ভদ্রলোকের বিশাল, নয়নাভিরাম গোলাপ বাগান। চারিদিক ছিল প্রায় জনশূন্য, শান্ত, স্নিগ্ধ। আমার বাবা এখানেই আমাদের ভবিষ্যতের নীড় গড়ে তুলেছিলেন। আমার বাবা এখানেই ১৯৮০ সালে জমি নিয়েছিলেন, প্লট নম্বর H/3/104। দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে তিনি সযত্নে বাড়িটি তৈরি করেন এবং ১৯৮৫ সালে আমরা সেই নতুন বাড়িতে বসবাস শুরু করি। আমি নিজে কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরিতে সবে যোগ দিয়েছি। বাবার বাড়ির ঠিক পাশের প্লটটিতেই (প্লট নম্বর H/3/103) আমি ১৯৮৭ সালের মার্চ মাসে জমি কিনে নিজের বাড়ি তৈরি করি। ১৯৮৫ সালে বাবার সেই বাড়ি (H/3/104) থেকে কেবল বিদ্যুৎ মুখার্জির বাড়িটাই দৃষ্টিগোচর হতো, বাকি চারিদিক ছিল দিগন্তবিস্তৃত ফাঁকা মাঠ। ভাবলে আজও অবাক লাগে, এই বিশাল প্রান্তরটি ছিল মিস্টার মেহের সিং নামে এক ব্যক্তির মালিকানাধীন। তার কাছ থেকেই পরবর্তীকালে শ্রদ্ধেয় মিস্টার রণেন ঘোষ, তন্ময় মন্ডল, কে কে পালিত প্রমুখ উদ্যোগী বাঙালি ব্যক্তিত্বরা জমি কিনে সেটিকে প্লটে ভাগ করে বাঙালিদের মধ্যে বিতরণ শুরু করেন, দিল্লিতে একটি বাঙালি বসতি স্থাপনের মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে।

আমি তখন সবেমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরিতে যোগ দিয়েছি। আমাদের জমি, পছন্দ হয়ে গেলে, আমার বাবা ১৫৪ বর্গগজের একটি প্লট কিনে নেন। সেখানে পরবর্তী কালে বাড়ীও তৈরী করা হয় । দাম শুনলে আজকের প্রজন্ম হয়তো বিশ্বাসই করবে না – প্রতি গজ মাত্র ৭ টাকা! এ যেন এক রূপকথার যুগ। ঠিক এই সময়েই, ১৯৮৫ সাল নাগাদ, আমাদের বাঙালি কমিউনিটির জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। আর. কে. পুরমের সুপরিচিত ও ঐতিহ্যবাহী 'বঙ্গদর্শন ক্লাব' তাদের কার্যক্রম স্থানান্তরিত করে নিয়ে আসে এই মহাবীর এনক্লেভে। এই ক্লাব অতি দ্রুত আমাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের অন্যতম প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল এবং আনন্দের বিষয় হলো, আজও এই ক্লাব অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে তার ভূমিকা পালন করে চলেছে। এখনও ক্লাবের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমরা সকলে মিলিত হই, আনন্দে মেতে উঠি, ভাগ করে নিই সুখ-দুঃখ।

বাচ্চু সমাদ্দারের বাড়ির সামনে একটি ফাঁকা প্লটে শুরু হলো আমাদের প্রথম দুর্গাপূজা। সে কী প্রবল উৎসাহ আর আন্তরিকতা! আজও যেন চোখের সামনে দেখতে পাই সেইসব দিনের ছবি। পুজোর অন্যতম আকর্ষণ ছিল ধুনুচি নাচের প্রতিযোগিতা। মনে পড়ছে, আমি, বিদ্যুতের স্ত্রী অর্পিতা আর কাজলী – আমরা তিনজন প্রায় প্রতি বছরই প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অধিকার করতাম। সে এক নির্মল আনন্দের যুগ ছিল, যেখানে প্রতিযোগিতা ছিল, কিন্তু রেষারেষি ছিল না।

এই বাঙালি কলোনির স্বপ্নদ্রষ্টা ও অন্যতম স্থপতি ছিলেন শ্রদ্ধেয় রণেন ঘোষ। তিনি নিজে উদ্যোগ নিয়ে আর. কে. পুরমের সরকারি আবাসন থেকে পরিচিত বাঙালিদের এখানে এনে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে উৎসাহিত করেছিলেন। তার নিরলস প্রচেষ্টাতেই এই রুক্ষ প্রান্তর ধীরে ধীরে এক প্রাণচঞ্চল বাঙালি পাড়ায় রূপান্তরিত হয়েছিল। আমার নিজের পরিচিত গণ্ডি ও আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে একে একে এখানে এসে জুটেছিলেন বিদ্যুৎ মুখার্জি, মনোজ মৈত্র, বাচ্চু সমাদ্দার, দিপু মুখার্জি, গীতি আচার্য, ছায়া মাসি, তরুণ চ্যাটার্জী সহ আরও কত চেনা মুখ। আমরা সবাই মিলেমিশে, হাতে হাত ধরে এক নতুন সমাজ, এক নতুন ঠিকানা গড়ে তোলার স্বপ্নে বিভোর ছিলাম।  

১৯৮২ সালের আগস্ট মাস আমার জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়। তপন ভট্টাচার্যের সঙ্গে আমার বিবাহ সম্পন্ন হয়। নতুন জীবনের সূচনা হয় সি. আর. পার্কে আমার ভাসুরের বাড়িতে। আমার ভাসুর, শ্রী শ্রীবাস ভট্টাচার্য, ছিলেন অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় এক ব্যক্তিত্ব – দক্ষিণ দিল্লি কালীবাড়ি, বঙ্গীয় সমাজ ও শিব মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। তার মতো একজন মানুষের আশীর্বাদ নিয়ে আমাদের পথচলা শুরু হয়েছিল। বিয়ের পর আমার স্বামী ডাবর ইন্ডিয়া লিমিটেডে কর্মরত ছিলেন। কাজের সূত্রে আমাদের ঠিকানা বদল হতে থাকে – সি. আর. পার্ক থেকে লক্ষ্মীনগর, সেখান থেকে দিলশাদ গার্ডেন। আমার নিজের কর্মস্থল ছিল পার্লামেন্ট স্ট্রিটের জীবনদীপ বিল্ডিং। কিন্তু মন পড়ে থাকতো মহাবীর এনক্লেভে, যেখানে আমাদের নিজেদের বাড়ি, নিজেদের সমাজ গড়ে উঠছে। অবশেষে, সমস্ত যাযাবর জীবনের অবসান ঘটিয়ে আমরা পাকাপাকিভাবে ফিরে আসি মহাবীর এনক্লেভে, আমাদের ভালোবাসার নীড়ে। 

মহাবীর এনক্লেভে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করার পর এখানকার শিক্ষা ও সংস্কৃতি জগতের সঙ্গে আমি ও আমার পরিবার ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়ি। আমার স্বামী তপন ভট্টাচার্য এখানকার কালীবাড়ি মন্দির কমিটির এক্সিকিউটিভ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীকালে, ২০১২ সালে যখন অশোক নন্দ সেক্রেটারি নির্বাচিত হন, তখন আমিও সেন্ট্রাল গভর্মেন্টের মিনিস্ট্রি অফ উইমেন অ্যান্ড চাইল্ড ডেভেলপমেন্টে কর্মরত থাকা সত্ত্বেও দুর্গাপূজা কমিটির বিভিন্ন কাজে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হই।

কালীবাড়ি কেবল একটি ধর্মীয় উপাসনালয় ছিল না, এটি অচিরেই আমাদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের এক মিলনক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। এখানেই আমরা গড়ে তুলেছিলাম 'সাহিত্যায়ন' – আমাদের বাংলা সাহিত্য চর্চার আসর। শ্রদ্ধেয় দিলীপ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন এই উদ্যোগের কান্ডারি। তার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতাম আমি, জয়শ্রী রায়, স্বপ্না ব্যানার্জি, ঝর্ণা ভট্টাচার্য সহ আরও কয়েকজন সাহিত্যপ্রেমী। এই সাহিত্যায়নের মঞ্চেই পীযূষের সঙ্গে আমাদের সাহিত্যিক বন্ধন আরও দৃঢ় হয়।

আমাদের উদ্যোগ কেবল সাহিত্য চর্চার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। নতুন প্রজন্মের মধ্যে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা জাগিয়ে তোলার জন্য আমরা কালীবাড়ি মন্দির প্রাঙ্গণে একটি বাংলা ক্লাস চালু করেছিলাম, যেখানে আমি শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন করতাম। পাশাপাশি, শরীর ও মনকে সুস্থ রাখার জন্য নিয়মিত যোগা ক্লাসেরও আয়োজন করেছিলাম, যার সূচনাও আমার হাত ধরেই হয়েছিল। এই সমস্ত উদ্যোগের পিছনে আমাদের একটাই আন্তরিক প্রয়াস ছিল – শত ব্যস্ততার মধ্যেও, দিল্লির বুকে আমাদের বাঙালিয়ানার ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখা এবং তাকে সযত্নে পরবর্তী প্রজন্মের হাতে তুলে দেওয়া।

কিন্তু হায়! সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুই তার স্বাভাবিক গতিপথ হারায়। কালীবাড়ির অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, কিছু মানুষের ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও রেষারেষি ধীরে ধীরে আমাদের এই সুস্থ ও সুন্দর সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলকে বিষিয়ে তুলতে শুরু করে। নোংরা রাজনীতির কালো থাবায় আমাদের অনেক স্বপ্নের উদ্যোগ, অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ একে একে বাধাপ্রাপ্ত হয়, স্তব্ধ হয়ে যায়। আজও যখন সেই দিনগুলোর কথা ভাবি, মনটা গভীর বেদনায় ভরে ওঠে।

'কথাঞ্জলি' ও সাহিত্যবাসরের স্বর্ণযুগ, অস্তরাগ ও পীযূষের ভূমিকা

কালীবাড়ির এই প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও একটি কাজ আমরা দাঁতে দাঁত চেপে চালিয়ে গিয়েছি – তা হলো 'কথাঞ্জলি' পত্রিকার প্রকাশনা। দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে মহাবীর এনক্লেভের বুক থেকে এই পত্রিকাটি আমরা নিয়মিত প্রকাশ করেছি। দিলীপ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের অক্লান্ত পরিশ্রম ও ভালোবাসায় গড়ে ওঠা 'সাহিত্যবাসর' ছিল আমাদের সাপ্তাহিক বা পাক্ষিক মিলনের কেন্দ্রবিন্দু, আমাদের প্রাণের আরাম, মনের খোরাক। কত গুণী, কত জ্ঞানী মানুষ যে এই আসরের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তার ইয়ত্তা নেই! শ্রদ্ধেয় ধনঞ্জয় ঘাঁটি, শান্তি সরকার, স্বপ্না ব্যানার্জি, শচীপতি ভট্টাচার্য, আমার স্বামী তপন ভট্টাচার্য, ঝর্ণা ভট্টাচার্য, জয়শ্রী রায়, ডক্টর ভৌমিক, মিস্টার কালীপদ ব্যানার্জি, বিদ্যুৎ মুখার্জি – এঁদের সকলের সক্রিয় উপস্থিতি আমাদের সাহিত্যবাসরকে এক অন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিল। গোপাল চন্দ্র পালের কথা এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ না করলেই নয়। তিনি ছিলেন একাধারে অত্যন্ত গুণী এবং অসম্ভব যত্নশীল একজন মানুষ। তার নিপুণ সম্পাদনা ও তত্ত্বাবধানে 'কথাঞ্জলি'র প্রতিটি সংখ্যা সময়মতো প্রকাশিত হতো। প্রতিটি লেখাকে তিনি পরম মমতায় পরিমার্জনা করতেন। এই পত্রিকার প্রতিটি পাতা ছিল আমাদের সম্মিলিত ভালোবাসা, শ্রম আর স্বপ্নের প্রতিচ্ছবি।

কিন্তু কোনও কিছুই চিরস্থায়ী নয়। কালের অমোঘ নিয়মে আমাদের সাহিত্যবাসরের সেই স্বর্ণযুগেও ধীরে ধীরে ভাটার টান লাগে। পুরনোরা কেউ কেউ বার্ধক্যের কারণে, কেউ অসুস্থতার কারণে, আবার কেউ বা ব্যক্তিগত কারণে ধীরে ধীরে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়তে থাকেন। যখন মনে হচ্ছিল আমাদের এই সাধের উদ্যোগ হয়তো এবার স্তব্ধ হয়ে যাবে, ঠিক সেই ক্রান্তিকালে এগিয়ে এসেছিল নতুন প্রজন্মের দুই প্রতিনিধি – ভাস্বতী রায় ঘোষ এবং আমাদের সবার প্রিয় পীযূষ কান্তি বিশ্বাস। তারা দুজনে মিলে এই ডুবতে বসা তরীটির হাল ধরেছিল। তাদের অক্লান্ত উদ্যম, নিষ্ঠা আর ভালোবাসায় 'কথাঞ্জলি' এবং সাহিত্যবাসর আরও কিছুদিন তার অস্তিত্ব সগৌরবে টিকিয়ে রাখতে পেরেছিল। তখন আমরা কেবল কালীবাড়ি প্রাঙ্গণেই নয়, পালা করে বিভিন্ন সদস্যের বাড়িতেও সাহিত্যবাসরের আয়োজন করতাম। এই তরুণ তুর্কিদের কাঁধে ভর দিয়েই আমাদের সাহিত্য চর্চার রথ এগিয়ে চলেছিল।

পীযূষকে আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। দেখেছি কী অসম্ভব যত্ন আর আন্তরিকতার সঙ্গে সে বাংলা সাহিত্যের জন্য কাজ করত। গোপালদার বিশ্বস্ত সহচর হিসেবে সে পত্রিকার প্রুফ দেখা থেকে শুরু করে লেখা সংগ্রহ, যোগাযোগ রাখা – সমস্ত কাজেই সাহায্য করত। শুধু তাই নয়, যে বাংলা ক্লাসটি আমরা শুরু করেছিলাম শিশুদের জন্য, পীযূষ সেই ক্লাসটিরও অন্যতম প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিল। নিজের পেশাগত ও ব্যক্তিগত ব্যস্ততার মধ্যেও সে নিয়ম করে সময় দিত, ছোটদের উৎসাহ জোগাতো, প্রয়োজনীয় সহায়তা করত। কিন্তু আজকের দিনের জটিল রাজনৈতিক সমীকরণ আর পারস্পরিক অবিশ্বাসের বাতাবরণে সেইসব মহৎ উদ্যোগ – আমাদের সাধের বাংলা ক্লাস, স্কুল গড়ার স্বপ্ন – সবই যেন কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এ এক অপূরণীয় ক্ষতি, এক গভীর দীর্ঘশ্বাস।   

আজকের মহাবীর এনক্লেভের দিকে তাকালে ফেলে আসা দিনের সঙ্গে মেলাতে কষ্ট হয়। কোথায় হারিয়ে গেল সেই আন্তরিক প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক, সেই সামাজিক বন্ধন? কালীবাড়িতে এখন কোর্ট কেস, পুলিশি হস্তক্ষেপ নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির বদলে জায়গা করে নিয়েছে বিভেদ, অবিশ্বাস আর তিক্ততা। এক সময়ের খোলামেলা, শান্ত, ছিমছাম কলোনি আজ বহুতল ফ্ল্যাটবাড়ির জঙ্গলে পরিণত, জনবহুল, কোলাহলপূর্ণ। আগে যেখানে এক-একটি স্বাধীন বাড়িতে বড়জোর ৪-৫ জন মানুষ বাস করত, আজ সেখানে এক-একটি ফ্ল্যাটবাড়িতে ৫০-৬০ জন বা তারও বেশি মানুষের বাস। স্বাভাবিকভাবেই, জল, নিকাশি ব্যবস্থা, গাড়ি পার্কিং – এই সব নাগরিক পরিষেবা নিয়ে নিত্যদিন লেগে আছে অশান্তি, ঝগড়া, মনোমালিন্য।

তবে সবচেয়ে বেশি যা আমাকে ব্যথিত করে, তা হলো আমাদের প্রিয় বাঙালি কলোনির নিজস্ব পরিচিতি ও চরিত্রের ক্রমবিলুপ্তি। এক সময় এই মহাবীর এনক্লেভকে লোকে গর্ব করে বলতো 'মিনি সি. আর. পার্ক'। আজ সেই গর্ব যেন ফিকে হয়ে আসছে। অর্থনৈতিক বা অন্যান্য কারণে বহু বাঙালি পরিবার তাদের বাড়ি বিক্রি করে নয়ডা, গ্রেটার নয়ডা বা সি. আর. পার্কে চলে যাচ্ছেন। সেই শূন্যস্থান দ্রুত পূরণ করছেন অবাঙালিরা। এতে কলোনির জনবিন্যাস ও সাংস্কৃতিক চরিত্রটাই আমূল বদলে যাচ্ছে। আমি স্তম্ভিত হয়ে যাই, যখন দেখি আমাদের প্রাণের কালীবাড়ির সান্ধ্য আরতির সময় অবাঙালি ভক্তদের ভিড়ে বাঙালিরা প্রায় অদৃশ্য। ১৯৮৫ সাল থেকে এই কলোনির প্রতিটি ইট, প্রতিটি ধূলিকণার সঙ্গে আমার পরিচয়। এর প্রতিটি পরিবর্তন, প্রতিটি স্পন্দন আমি অনুভব করেছি। তাই এই ক্ষয়িষ্ণু রূপ, এই সাংস্কৃতিক অবক্ষয় আমাকে গভীরভাবে পীড়া দেয়। মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে মনে – বাংলা ভাষা, বাঙালি সংস্কৃতি কি এখানে এভাবেই ধীরে ধীরে তার অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলবে?

কিন্তু এত হতাশার মধ্যেও আশার আলো একেবারে নিভে যায়নি। সাহিত্যবাসর বা কালীবাড়ির সেই পুরনো উদ্যোগগুলি হয়তো স্তিমিত, কিন্তু বাঙালির উৎসবপ্রিয় মন একেবারে থেমে যায়নি। আমাদের সেই ঐতিহ্যবাহী বঙ্গদর্শন ক্লাব আজও সক্রিয়। এছাড়াও বছরের বিভিন্ন সময়ে আমরা নানা উপলক্ষে একত্রিত হই, পালন করি আমাদের নিজস্ব কৃষ্টি ও সংস্কৃতি। আর এইসব অনুষ্ঠানেও পীযূষকে আমরা পাশে পাই। তার সক্রিয় অংশগ্রহণ আমাদের আনন্দকে বাড়িয়ে তোলে।

সেটা হোক ২৬শে জানুয়ারী গণপ্রজাতন্ত্র দিবসের পতাকা উত্তোলন আর প্রভাতফেরী, অথবা বাগ্‌দেবীর আরাধনায় সরস্বতী পূজা, কিংবা পয়লা বৈশাখে নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়ার আনন্দ (শুভ নববর্ষ উদযাপন), অথবা আমাদের মণীষীদের স্মরণ – রবিঠাকুর, নজরুল ইসলাম ও সুকান্ত ভট্টাচার্যের জন্মজয়ন্তী পালন, অথবা দুর্গাপূজার পর বিজয়া সম্মিলনীর আন্তরিক শুভেচ্ছা বিনিময়, রঙের উৎসব হোলি মিলন, কিংবা সকলে মিলে একসাথে বনভোজনে (পিকনিক) মেতে ওঠা – এই সমস্ত অনুষ্ঠানেই পীযূষের উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। সে আসে, সকলের সঙ্গে মেশে, আনন্দ ভাগ করে নেয়, কখনও বা আয়োজনেও সাহায্য করে। এই ছোট ছোট উদযাপনগুলিই হয়তো এখন আমাদের সামাজিক বন্ধনকে বাঁচিয়ে রেখেছে, আমাদের বাঙালিয়ানার পরিচয়কে টিকিয়ে রেখেছে। 

এত আক্ষেপ, এত পরিবর্তনের সাক্ষী হয়েও যখন পীযূষের কথা ভাবি, মনটা ভালোলাগায় ভরে ওঠে। আমাদের ছোটদের সেই বাংলা ক্লাস, সাহিত্যায়নের সেই প্রাণবন্ত সাহিত্যসভা, কবিতা পাঠের আসর, 'কথাঞ্জলি' পত্রিকার প্রতিটি সংখ্যার জন্য তার ছোটাছুটি, এমনকি নিজেদের উদ্যোগে করা রুম থিয়েটার – এই সব কিছুর সঙ্গেই পীযূষের স্মৃতি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। সাহিত্য নিয়ে তার নিরন্তর উৎসাহ, তার সক্রিয় অংশগ্রহণ আমাদের সবসময় অনুপ্রাণিত করেছে। আমরা তখন মনে মনে ভাবতাম, এই তরুণ ছেলেটিই একদিন আমাদের মহাবীর এনক্লেভের মুখ উজ্জ্বল করবে, এখানকার বাংলা সাহিত্য চর্চাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

কতবার যে আমরা পীযূষের বাড়িতে সাহিত্যবাসরের আয়োজন করেছি, তার ইয়ত্তা নেই। ওর বাড়ির বৈঠকখানাটি যেন হয়ে উঠেছিল আমাদের এক অস্থায়ী সাহিত্য তীর্থ। সেখানে আমরা শ্রুতিনাটকও পরিবেশন করেছি। পীযূষের স্ত্রী, বিউটি বিশ্বাস, এক অত্যন্ত অমায়িক, হাসিখুশি এবং অতিথিপরায়ণ নারী। তার আন্তরিক আপ্যায়নের স্মৃতি আজও আমার মনে উজ্জ্বল। তাদের ছিমছাম, গোছানো সংসারটা যেন সাহিত্য, ভালোবাসা আর আন্তরিকতার এক অপূর্ব মেলবন্ধন।

আজ পীযূষ তার জীবনের পঞ্চাশতম বসন্তে পদার্পণ করলো। ভাবতেই অবাক লাগে, দেখতে দেখতে কতগুলো বছর নিমেষে পেরিয়ে গেল! আমার হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে তার জন্য রইল অফুরান শুভেচ্ছা আর অজস্র আশীর্বাদ। আগামী দিনগুলো যেন তার জীবনে নিয়ে আসে আরও আনন্দ, আরও সাফল্য। সে যেন সুস্থ থাকে, সপরিবারে ভালো থাকে, আর তার সৃষ্টিশীল সত্তা যেন কখনও বিশ্রাম না নেয়। সাহিত্যবাসর হোক, বাংলা ক্লাস হোক, কিংবা পাড়ার যে কোনও সামাজিক বা সাংস্কৃতিক উদ্যোগ – অনেক ক্ষেত্রেই তোমাকে আমরা নিঃস্বার্থভাবে পাশে পেয়েছি পীযূষ। আশা রাখি, আগামী দিনেও বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির যে কোনও প্রয়োজনে তোমাকে আমরা একইরকমভাবে পাশে পাবো।

তোমার একক উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ওয়েবজিন 'দেহলিজ'-এর কথা আজ কে না জানে! দিল্লির গণ্ডি ছাড়িয়ে দেশ-বিদেশের বাংলাভাষী পাঠক ও লেখকদের কাছে এটি এক পরিচিত ও সম্মানিত নাম। তোমার এই কৃতিত্বে, তোমার এই সাফল্যে আমরা মহাবীর এনক্লেভের পুরনো বাসিন্দারা সত্যি খুব গর্বিত। তুমি প্রমাণ করেছো, নিষ্ঠা আর ভালোবাসা থাকলে একার উদ্যোগেও অনেক বড় কাজ করা যায়। তুমি আজ কেবল মহাবীর এনক্লেভের নও, তুমি সমগ্র বাংলা সাহিত্যের এক কৃতি সন্তান।

  

জীবন নদীর মতো বহমান। পরিবর্তন তার ধর্ম। আমাদের প্রিয় মহাবীর এনক্লেভ হয়তো তার অতীতের জৌলুস বা চরিত্র কিছুটা হারিয়েছে, কিন্তু পীযূষের মতো কিছু মানুষের ব্যক্তিগত নিষ্ঠা, একাগ্রতা আর বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি নিখাদ ভালোবাসা এখনও ভবিষ্যতের জন্য আশার আলো জিইয়ে রাখে। তার মধ্যে প্রযুক্তিবিদের যুক্তিনিষ্ঠ মনন এবং কবির সংবেদনশীল হৃদয়ের যে আশ্চর্য সহাবস্থান, তা সত্যিই বিরল এবং প্রশংসনীয়। একদিকে সে আন্তর্জাতিক স্তরের কর্পোরেট জগতে এক সফল ক্লাউড আর্কিটেক্ট, অন্যদিকে সে বাংলা কবিতার জগতে এক নিজস্ব কণ্ঠস্বর, একজন দক্ষ সম্পাদক ও নিবেদিতপ্রাণ সংগঠক। এই দুই আপাত-বিপরীত সত্তাকে সে যেভাবে অনায়াসে এবং সার্থকভাবে বহন করে চলেছে, তা আজকের প্রজন্মের কাছে এক দৃষ্টান্ত।

আমার স্নেহের পীযূষ কান্তি বিশ্বাসের জন্য রইল আমার অফুরান ভালোবাসা, আশীর্বাদ ও শুভকামনা। তার কলম আরও শাণিত হোক, তার মেধা ও মনন বাংলা সাহিত্য এবং একইসঙ্গে প্রযুক্তি জগৎকে আরও সমৃদ্ধ করুক। সে দীর্ঘজীবী হোক, প্রতিষ্ঠিত হোক, তার পথচলা হোক নিরন্তর ও কুসুমাস্তীর্ণ – এই আমার ঈশ্বরের কাছে একান্ত প্রার্থনা। তুমি খুব ভালো থেকো, সুস্থ থেকো, আনন্দে থেকো, আমাদের সকলের প্রিয় পীযূষ।