অপূর্ব সাহা

পীযূষকান্তি বিশ্বাস একজন সত্য মিত্র

অপূর্ব সাহা



আমার দিল্লিবাস পঁচিশ বছর পূর্ণ হতে চললো। এই দীর্ঘ সময়ে কাজের জগতে, বাসস্থানের দৌলতে অনেকের সঙ্গেই চেনা পরিচিতি হয়েছে। সময়ের তাগিদে ও কালের নিয়মে সবার সাথে সম্পর্কের বাঁধন পাকাপাকি হয়ে ওঠে নি। কিন্তু বেশ কিছু মানুষ আছেন যাঁরা সত্যিকারের বন্ধু হয়ে উঠেছেন। পীযূষ কান্তি বিশ্বাস সেই সব বন্ধুদের মধ্যে অন্যতম একজন।

আজ যখন দেহলিজ পত্রিকার বিশেষ সংখ্যার জন্য লিখতে বসেছি, আমার মনে অনেক স্মৃতি ভেসে আসছে। মহাবীর এনক্লেভে বসবাস শুরু করার আগে থেকেই এই অঞ্চলে আমার যাতায়াত ছিলো। এখানকার কয়েকজন বাঙালি, সাহিত্যকে ভালোবেসে 'কথাঞ্জলী' পত্রিকা প্রকাশ করতেন। সঙ্গে মাসের এক নির্দিষ্ট দিনে বিকাল বেলাতে বসতো সাহিত্যআসর। সেখানে সবাই স্বরচিত লেখা কবিতা, প্রবন্ধ, গল্প পাঠ করতেন। তারপর সেইসব লেখার আলোচনা করা হতো। সাহিত্যবাসরে যোগ দিয়ে অনেক বিষয় সম্পর্কে জানতে পেরেছি। মহাবীর এনক্লেভে ওই সময় ছোটোদের বাঙলা শেখানোর জন্য রবিবারের সকাল বরাদ্দ থাকতো। ঠিক তখনই পরিচয় হয় আমারই প্রায় সমবয়স্ক পীযূষকান্তি বিশ্বাসের সঙ্গে। পরিচিতি পর্বের শুরু থেকেই আমরা একে অপরকে 'বন্ধু' বলে সম্বোধন করে থাকি।


বিভিন্ন পরিবর্তন ও পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে আমাদের জীবনধারা বয়ে চলতে থাকে। সেই পরিবর্তনের এক উদাহরণ কাজের তাগিদে সাহিত্য আসরে আমার যোগ দেবার অবকাশ ধীরে ধীরে কম হতে থাকে।

পীযূষ সদা হাস্যময়, প্রাণবন্ত এবং অমায়িক। ওর বাড়িতে বসেও অনেক সময় সাহিত্য চর্চা করেছি। ওর লেখা কবিতার বই থেকে কবিতা আবৃত্তি করে শুনিয়েছে।

পীযূষকান্তি নিজে সাহিত্য সাধনা করে যাচ্ছেন এবং তার সঙ্গেই প্রকাশক, সম্পাদকের কাজ ও করে যাচ্ছেন। আমাদের পরিচয়ের ইতিহাস দীর্ঘ। আর তা জড়িয়ে আছে দিল্লির বুকে বাংলা ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার এক আন্তরিক প্রচেষ্টার সঙ্গে।

আমার শিক্ষাজীবনের বেশীরভাগ সময় কেটেছে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতীর আঙিনায়। আমার হৃদয়ে সর্বদা অনুরণিত হয় শান্তিনিকেতনের স্নিগ্ধ বাতাস, সেখানকার সাহিত্য আর সংস্কৃতির অমৃতধারা। সেখানে ছাত্রজীবনে সাহিত্যের যে বীজ আমার অন্তরে রোপিত হয়েছিল, দিল্লির কর্মব্যস্ত জীবনেও তার অঙ্কুর শুকিয়ে যায়নি। বরং, ইট-কাঠের এই জঙ্গলে সেই সবুজটুকু বাঁচিয়ে রাখার এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা সবসময় অনুভব করতাম।


২০০৮ সালে দিল্লির মহাবীর এনক্লেভে বসবাস করার সিদ্ধান্তের অন্যতম কারণ ছিলো বাঙালি পরিবেশ ও বাঙলা সাহিত্য চর্চা। নতুন পরিবেশে

মহাবীর এনক্লেভের দিনগুলোতে আমার সাহিত্যচর্চার প্রধান আশ্রয় হয়ে উঠেছিল ‘কথাঞ্জলী’ পত্রিকা। পত্রিকার কর্ণধার ব্যানার্জীকাকু একদিন আমাকে পীযূষের কথা বলেন। তারপর

পীযূষকান্তির সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ সম্ভবত কোনও এক সাহিত্য আড্ডায় কিংবা কথাঞ্জলীর কার্যালয়ে। প্রথম পরিচয়েই আমরা অনুভব করেছিলাম, আমাদের দুজনের হৃদয়েই বাংলা সাহিত্যের প্রতি এক অকৃত্রিম টান রয়েছে। সেই সূত্র ধরেই ধীরে ধীরে আমাদের মধ্যে গড়ে ওঠে এক গভীর বন্ধুত্ব, যা শুধু ব্যক্তিগত স্তরেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, প্রবাসের সাহিত্যচর্চার আঙিনাকেও সমৃদ্ধ করেছিল।

কথাঞ্জলীর সেই দিনগুলোতে আমরা ছিলাম এক ঝাঁক উৎসাহী সাহিত্যপ্রেমী। আমারা সাহিত্য আলোচনাতে নবীন-প্রবীণে খুব সুন্দর ভাবে মিশে যেতাম। আমাদের মধ্যে নিয়মিত সাহিত্য আড্ডা বসত, যেখানে কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ নিয়ে আলোচনা হত। সেই আড্ডাই একসময় একটি সুসংগঠিত রূপ নেয় – আমরা একটি সাহিত্য গোষ্ঠী তৈরি করি, যার নাম দিয়েছিলাম ‘সাহিত্যায়ন’। নামটি যেমন সুন্দর, তেমনই তাৎপর্যপূর্ণ ছিল আমাদের কাছে। প্রবাসের মাটিতে বাংলা সাহিত্যকে আমরা যেন নতুন করে স্থাপন করতে চেয়েছিলাম, তার চর্চাকে একটি সুস্পষ্ট দিশা দিতে চেয়েছিলাম।

সাহিত্যায়ন শুধু সাহিত্য আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না,  প্রবাসে বেড়ে ওঠা নতুন প্রজন্মের মধ্যে বাংলা ভাষার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করাও ছিল আমাদের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। সেই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে আমরা একটি বাংলা শিক্ষাকেন্দ্র পরিচালনা শুরু করি। সপ্তাহের শেষে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা আসত আমাদের কাছে বাংলা বর্ণমালা শিখতে, ছড়া, কবিতা আবৃত্তি করতে।

পীযূষকান্তি ছিলেন সাহিত্যায়নের অন্যতম স্তম্ভ। তার সাংগঠনিক দক্ষতা এবং সাহিত্যের প্রতি গভীর অনুরাগ আমাদের সবসময় অনুপ্রাণিত করত। তিনি শুধু নিজে লিখতেন না, অন্যদেরও লিখতে উৎসাহিত করতেন, তাদের লেখার ভুলত্রুটি ধরিয়ে দিতেন স্নেহপূর্ণ ভঙ্গিতে। আমাদের উদ্যোগে আমরা বেশ কয়েকটি সাহিত্য সংকলনও প্রকাশ করেছিলাম, যেখানে প্রবাসে বসবাসকারী বাঙালি লেখকদের রচনা স্থান পেত। সেই পত্রিকাগুলি ছিল আমাদের সাহিত্যচর্চার ফসল, প্রবাসের বুকে বাংলা ভাষার অস্তিত্বের নীরব সাক্ষী।

স্মৃতির পাতায় আজও উজ্জ্বল হয়ে আছে সেই দিনগুলি, যখন আমরা সকলে মিলে একটি বাংলা পত্রিকা প্রকাশের স্বপ্ন দেখেছিলাম। সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য আমরা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলাম। পীযূষকান্তি ছিলেন সেই পত্রিকার প্রাণপুরুষ। তিনি শুধু সম্পাদনার দায়িত্বই নেননি, পত্রিকার নকশা থেকে শুরু করে ছাপা পর্যন্ত সমস্ত কাজ নিজের হাতে সামলেছিলেন। সেই পত্রিকাটি হয়তো বাণিজ্যিকভাবে সফল হয়নি, কিন্তু প্রবাসের সাহিত্য ইতিহাসে তা একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। কারণ, সেই পত্রিকার প্রতিটি পাতায় ছিল আমাদের সম্মিলিত আবেগ, বাংলা ভাষার প্রতি আমাদের গভীর ভালোবাসা।

জীবনের নানা ঘাত প্রতিঘাতে একসময় হয়তো আমাদের সেই সরাসরি সাহিত্যচর্চার গতি কিছুটা স্তিমিত হয়ে এসেছিল। কিন্তু পীযূষকান্তির সাহিত্য সাধনা কখনও থেমে থাকেনি। দিল্লির বুকে দাঁড়িয়েও তিনি বাংলা ভাষার পতাকা উঁচিয়ে ধরে রেখেছেন। আজ তিনি ‘দেহলিজ’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করছেন। নামটি যেমন কাব্যিক, তেমনই ব্যঞ্জনাময়। দেহলিজ যেন এক নতুন দিগন্তের সূচনা করে, প্রবাসে বাংলা সাহিত্যকে আরও বৃহত্তর পাঠককুলের কাছে পৌঁছে দেওয়ার এক আন্তরিক প্রচেষ্টা।

আমি অত্যন্ত আনন্দিত ও গর্বিত যে আমার লেখাও দেহলিজের পাতায় স্থান পায়। যখন দেহলিজের কোনও সংখ্যা হাতে পাই, তখন মনে হয় যেন পুরনো দিনের সেই সাহিত্য আড্ডায় ফিরে গিয়েছি। পত্রিকার প্রতিটি পাতায় পীযূষকান্তির সেই সাহিত্যিক স্পর্শ অনুভব করি, সেই পুরনো বন্ধুর উদ্যম আর একাগ্রতা দেখতে পাই।

আমাদের দীর্ঘদিনের সাহিত্য যাপনে অনেক চড়াই-উতরাই এসেছে। প্রবাসের জীবনে নানা ব্যস্ততার মধ্যেও আমরা কখনও বাংলা ভাষার প্রতি আমাদের ভালোবাসা হারাইনি। পীযূষকান্তি বিশ্বাসের মতো মানুষরা সেই ভালোবাসাকে আজও বাঁচিয়ে রেখেছেন, নতুন প্রজন্মের কাছে সেই ঐতিহ্যকে পৌঁছে দেওয়ার নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

আজ যখন দেহলিজের পাতায় এই কথাগুলো লিখছি, তখন আমার মনে পড়ছে সেইসব দিনের কথা, যখন আমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রবাসের মাটিতে বাংলা সাহিত্যের চারাগাছ রোপণ করেছিলাম। সেই চারাগাছ আজ মহীরুহ না হলেও, তার শাখা-প্রশাখা বিস্তার করেছে বহুদূর। আর সেই বিস্তারের পথে পীযূষকান্তি বিশ্বাসের অবদান অনস্বীকার্য। দেহলিজ পত্রিকা সেই বিস্তৃত বৃক্ষের একটি নতুন পল্লব, যা প্রবাসের সাহিত্যাকাশে আরও দীর্ঘকাল আলো ছড়াক, এই কামনাই করি। বন্ধু পীযূষ, তোমার এই একাগ্রতা আর সাহিত্যপ্রীতির কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ। আমাদের সেই পুরনো দিনের সাহিত্য যাপন, আমাদের বন্ধুত্ব – সবকিছুই আমার জীবনের অমূল্য সম্পদ। আর দেহলিজ সেই স্মৃতির এক উজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি হয়ে সবসময় আমার হৃদয়ে থাকবে।