মনীষা কর বাগচী
আমার সাহিত্যচর্চার পথপ্রদর্শক
মনীষা কর বাগচী
“প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে
মোরে আরো আরো আরো দাও প্রাণ।
তব ভুবনে তব ভবনে
মোরে আরো আরো আরো দাও স্থান ॥
আরো আলো আরো আলো”
( রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর )
আমার নাম মনীষা কর বাগচী। জীবনের এক সন্ধিক্ষণে, উচ্চ মাধ্যমিকের চৌকাঠ পেরোনোর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই, বিবাহ সূত্রে পাড়ি জমালাম এক সম্পূর্ণ ভিন্ন জগতে – দিল্লিতে। নদীয়ার সবুজ স্নিগ্ধ কোল ছেড়ে এসে পড়লাম ইট-সিমেন্টের এক বিশাল অরণ্যে। এ এক এমন জগৎ, যেখানে আমার পরিচিত মুখের সারি নেই, আত্মীয়-পরিজনের উষ্ণতা নেই, নেই আমার প্রাণের বাংলা ভাষা বা সংস্কৃতির সহজ চলাচল। গান নেই, কবিতা নেই, নেই প্রাণের আরাম দেওয়া সেই চেনা সুর। হাজারো মানুষের ভিড়েও এ এক অদ্ভুত নিঃসঙ্গতার জগৎ। দমবন্ধ করা এই পরিবেশে আমি প্রতিনিয়ত হাঁপিয়ে উঠছিলাম। শরীরটা হয়তো বেঁচে ছিল, যান্ত্রিকভাবে দিন কেটে যাচ্ছিল, কিন্তু তাতে প্রাণের কোনো স্পন্দন ছিল না, ছিল না বেঁচে থাকার আনন্দ।
আমার সেই বিবর্ণ, প্রায় নিষ্প্রাণ জীবনে যিনি প্রথম রঙের ছোঁয়া এনে দিলেন, নতুন করে প্রাণের সঞ্চার করলেন, তিনি হলেন কবি, সম্পাদক ও সংগঠক পীযূষকান্তি বিশ্বাস। তাই আজ যখন তাঁর সম্পর্কে আমার অনুভূতি ব্যক্ত করার সামান্য সুযোগ এসেছে, তখন এই সুযোগ আমি হাতছাড়া করি কী করে? এ শুধু কৃতজ্ঞতা প্রকাশ নয়, এ আমার নিজের পুনর্জন্মের গল্প বলার এক প্রয়াসও বটে। যখন তাঁর সম্পর্কে দু’কথা লেখার সুযোগ পেয়েছি,এ সুযোগ ছাড়ি কি করে?
ডিজিটাল যুগের আশীর্বাদ – ফেসবুক। সেখানেই শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক অজিত রায় এবং অকালপ্রয়াত প্রিয় কবি দীপঙ্কর দত্তের ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে পীযূষবাবুর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে। সেই পরিচয় ছিল সম্পূর্ণ ভার্চুয়াল, কিন্তু তাঁর আন্তরিক কথাবার্তা আর বাংলা সাহিত্যের প্রতি গভীর অনুরাগ আমাকে প্রথম থেকেই আকৃষ্ট করেছিল। তিনিই আমাকে প্রথম জানালেন যে, এই আপাতদৃষ্টিতে রুক্ষ, কর্মব্যস্ত দিল্লিতেও বাংলা সাহিত্যের একটি ফল্গুধারা নীরবে বয়ে চলেছে। এখানেও গান আছে, কবিতা আছে, সাহিত্য আড্ডা আছে, আর আছে প্রাণের উষ্ণতা। তিনিই আমার সামনে দিল্লির সাহিত্য জগতের দরজাটা প্রথম খুলে দিয়েছিলেন, হাত ধরে প্রবেশ করিয়েছিলেন এক নতুন ভুবনে।
পরবর্তীকালে আমাদের আলাপ যখন আরও গভীর হয়, তখন জানতে পারি এক আশ্চর্য সমাপতন – আমরা দুজনেই নদীয়ার সন্তান, এমনকি আমাদের কলেজও এক – রানাঘাট কলেজ! হয়তো একই মাটির টান, একই প্রতিষ্ঠানের স্মৃতি – এই সবকিছু মিলিয়েই তাঁর প্রতি আমি প্রথম থেকেই এক গভীর আত্মিক টান অনুভব করি।
আমাদের এই প্রিয় মানুষটির জীবনের দিকে তাকালে দেখি এক বর্ণময় পথচলা। ১৯৭৫ সালের ১৫ই মে, পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার এক ছবির মতো সুন্দর, সবুজ শ্যামল গ্রাম বহিরগাছিতে তাঁর জন্ম। গ্রাম বাংলার সেই নির্মল প্রকৃতি, সেই খোলা মাঠ, পুকুর, ধানক্ষেতের মাঝেই তাঁর বেড়ে ওঠা। সেই সবুজ হয়তো তাঁর মনে এমন গভীর ছাপ ফেলেছিল যে, আজও তাঁর কবিতায়, তাঁর লেখায় আমরা বারবার সেই প্রকৃতির স্নিগ্ধ ছোঁয়া পাই, খুঁজে পাই মাটির সোঁদা গন্ধ। পড়াশোনায় ছিলেন বরাবরই মনোযোগী। ১৯৯০ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হওয়ার পর বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন রানাঘাট কলেজে। কিন্তু কলেজের গণ্ডি পেরোনোর পর গতানুগতিক পথে না হেঁটে, ১৯৯৩ সালে তিনি বেছে নেন দেশসেবার পথ, যোগদান করেন ভারতীয় বিমান বাহিনীতে। কর্মজীবনের কঠোর অনুশাসনের মধ্যেও কিন্তু নিজের জ্ঞানস্পৃহাকে তিনি বাঁচিয়ে রেখেছিলেন।
২০০০ সালে তাঁর জীবনে আসে আরও এক বসন্ত। তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন বিউটি বিশ্বাসের সঙ্গে। নামের মতোই মিষ্টি আর সুন্দর মনের মানুষ তিনি। ২০০৪ সালে তাঁদের ঘর আলো করে আসে একমাত্র পুত্র ঋজুস্মিত। স্ত্রী ও পুত্রকে নিয়ে দিল্লিতে তাঁর এক ছিমছাম, সুখী গৃহকোণ। দিল্লির মহাবীর এনক্লেভ বাঙালি কলোনিতে একটি নিজস্ব ফ্ল্যাট কিনে তিনি এখন এই শহরের স্থায়ী বাসিন্দা। তবে কেবল ব্যক্তিগত জীবন বা পেশাগত দায়িত্বেই তিনি নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। মহাবীর এনক্লেভ এবং বৃহত্তর দিল্লির বুকে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রসারে ও সার্বিক শ্রীবৃদ্ধিতে তিনি নীরবে কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছেন।
কর্মজীবনের গুরুদায়িত্ব সামলেও পড়াশোনার প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল অদম্য। কাজের ফাঁকে সময় বের করে তিনি ইন্দিরা গান্ধী ন্যাশনাল ওপেন ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশনে স্নাতকোত্তর (এমসিএ) ডিগ্রি অর্জন করেন ২০০৩ সালে। ভারতীয় বিমান বাহিনীর সম্মানজনক চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করার পর তিনি কর্পোরেট জগতে প্রবেশ করেন এবং নিজের মেধা ও দক্ষতায় বর্তমানে একটি প্রথম সারির বহুজাতিক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত।
পীযূষকান্তি বিশ্বাসের অনন্যতা এখানেই যে, তিনি একদিকে যেমন একজন সফল প্রযুক্তিবিদ, তেমনই অন্যদিকে বাংলা সাহিত্যের প্রতি তাঁর ভালোবাসা, নিষ্ঠা ও সক্রিয়তা সত্যিই বিস্ময়কর। তিনি কেবল একজন নিভৃতচারী কবি বা পড়ুয়া নন, সাহিত্যের সাংগঠনিক দিকটিতেও তাঁর অবদান অত্যন্ত মূল্যবান।
দিগঙ্গন: দিল্লির ঐতিহ্যবাহী ও সুপরিচিত প্রতিষ্ঠান বেঙ্গল অ্যাসোসিয়েশন থেকে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকা 'দিগঙ্গন'-এর সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। ২০১৬ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত তিনি এই পত্রিকার সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
দেহলিজ: তাঁর সাহিত্যিক উদ্যোগের এক মাইলফলক হলো 'দেহলিজ' ওয়েব ম্যাগাজিন। ২০১৮ সালে তিনি সম্পূর্ণ একক প্রচেষ্টায় এই ওয়েব ম্যাগাজিনটি শুরু করেন। আমার সৌভাগ্য, এই পত্রিকার সূচনালগ্ন থেকেই আমি এর সঙ্গে জুড়ে আছি। স্পষ্ট মনে পড়ে, এক রবীন্দ্রজয়ন্তীর পুণ্য লগ্নে এই পত্রিকার আনুষ্ঠানিক উন্মোচন হয়েছিল, আর আমি সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী ছিলাম। পীযূষবাবু অত্যন্ত যত্ন ও নিষ্ঠার সঙ্গে 'দেহলিজ'-এর সম্পাদনা করে চলেছেন। অল্প সময়ের মধ্যেই এই পত্রিকাটি দেশ-বিদেশের বাংলাভাষী লেখক ও পাঠকদের কাছে এক নির্ভরযোগ্য ও প্রিয় প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়েছে। পরবর্তীকালে 'দেহলিজ'-এর নির্বাচিত লেখা নিয়ে একাধিক মুদ্রিত সংস্করণও প্রকাশিত হয়েছে, যা এই উদ্যোগের সাফল্যকে আরও সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। আমি নিজেও 'দেহলিজ'-এর একজন নিয়মিত লেখক হতে পেরে গর্বিত।
শূন্যকাল: বন্ধু ও কবি প্রয়াত দীপঙ্কর দত্তের স্মৃতিবিজড়িত ওয়েব ম্যাগাজিন 'শূন্যকাল'-এর সম্পাদনার গুরুদায়িত্বও তিনি বন্ধুর প্রয়াণের পর অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে কিছুকাল সামলেছেন।
অন্যান্য উদ্যোগ: এছাড়াও দিল্লির অন্যান্য সাহিত্য উদ্যোগের সঙ্গেও তিনি বিভিন্ন সময়ে যুক্ত থেকেছেন, যেমন – পালাম কলোনি থেকে প্রকাশিত 'প্রতিভা পথিকৃৎ' পত্রিকার পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন, মহাবীর এনক্লেভের দীর্ঘদিনের সাহিত্য পত্রিকা 'কথাঞ্জলী'র কোষাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
সাহিত্যিক আড্ডা ও সংযোগ স্থাপন: পীযূষবাবু কেবল পত্রিকা সম্পাদনাতেই থেমে থাকেননি। 'দেহলিজ'-এর উদ্যোগে তিনি নিয়মিত সাহিত্য আড্ডার আয়োজন করেন, যেখানে দিল্লির লেখকরা একত্রিত হন, নিজেদের লেখা পাঠ করেন, আলোচনা করেন। আমি নিজেও এই আড্ডাগুলিতে সানন্দে যোগদান করি। এ ছাড়াও, তাঁর তৈরি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ 'দিল্লির বাংলা সাহিত্য' আমার মতো দিল্লির অনেক সাহিত্যপ্রেমী মানুষের কাছে সত্যিই এক 'লাইফলাইন'। এই গ্রুপে আমরা নিয়মিত সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করি, নিজেদের মতামত জানাই, এবং আমি নিজেও আমার লেখা কবিতা সেখানে পোস্ট করি। গ্রুপের সদস্যরা, বিশেষ করে পীযূষবাবু নিজে, অত্যন্ত গঠনমূলক মতামত দিয়ে আমাদের উৎসাহিত করেন, লেখার মান উন্নয়নে সাহায্য করেন। এই গ্রুপটি দিল্লির বিচ্ছিন্ন সাহিত্যিকদের মধ্যে একটা সেতুবন্ধনের কাজ করেছে।
ব্যক্তিগত সংযোগ ও স্মৃতি: পীযূষবাবুর সঙ্গে আমার কেবল ভার্চুয়াল বা সাহিত্যিক সম্পর্ক নয়, বেশ কয়েকবার দেখাও হয়েছে। বিভিন্ন সাহিত্য আড্ডা, অনুষ্ঠান বা বইমেলায় তাঁর সঙ্গে দেখা হওয়ার সুযোগ হয়েছে। বইমেলার সেই দিনটার কথা খুব মনে পড়ে – একসঙ্গে সেলফি তুলে সে কী হাসাহাসি! এই সহজ, আন্তরিক মুহূর্তগুলোই সম্পর্কগুলোকে আরও গভীর করে তোলে।
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ:
তাঁর কবিতার অল্পকিছু পাঠের অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে । আমি অনেক কিছু সেখানে থেকে আরোহণ করার চেষ্টা করি । তাঁর কবি সত্তার স্ফুরণ ঘটেছে তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলিতে। তাঁর কবিতা জটিলতার বেড়াজাল এড়িয়ে সরাসরি পাঠকের মনের গভীরে প্রবেশ করে। প্রেম, প্রকৃতি, ফেলে আসা দিনের স্মৃতি, প্রবাস জীবনের অনুভূতি, সামাজিক দায়বদ্ধতা – নানা বিষয় উঠে আসে তাঁর কলমে, এক নিজস্ব ঘরানায়। তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলি হলো: ১. বাঁধা নয় রক্ত (২০০৮), ২. ঘুমঘর (২০১৪) ৩. আকাশচুম্বন (২০১৬) । আকাশচুম্বন গ্রন্থটি আমি দিল্লি বইমেলায় সংগ্রহ করি ।
পীযূষকান্তি বিশ্বাসকে আমি খুব কাছ থেকে দেখার এবং কিছুটা জানার সুযোগ পেয়েছি। সেই অভিজ্ঞতা থেকে নির্দ্বিধায় বলতে পারি, তিনি এক বিরল বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তিনি নিঃসন্দেহে একজন ভালো কবি, যাঁর কলমে অনুভূতির সূক্ষ্ম প্রকাশ ঘটে। তিনি একজন দক্ষ ও নিপুণ সম্পাদক, যিনি নিজে লেখার পাশাপাশি অন্যদের লেখা যত্ন সহকারে সম্পাদনা করেন এবং নতুন প্রতিভাদের এগিয়ে আসতে সাহায্য করেন। তিনি একজন নির্ভরযোগ্য ও ভালো বন্ধু, যাঁর আন্তরিকতা ও সহযোগিতার উপর আস্থা রাখা যায়। নতুন লেখক বা সাহিত্য জগতে আসতে আগ্রহীদের জন্য তিনি একজন চমৎকার পথপ্রদর্শক ও গাইড। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি একজন আদর্শ স্বামী ও স্নেহময় পিতা।
আর এই সমস্ত পরিচয়ের ঊর্ধ্বে তাঁর যে পরিচয়টি সবচেয়ে উজ্জ্বল, তা হলো – তিনি একজন খাঁটি ভালো মনের মানুষ। তাঁর বিনয়, তাঁর নিরহংকার প্রকৃতি, সকলের সঙ্গে সহজভাবে মিশে যাওয়ার ক্ষমতা এবং অপরের প্রতি তাঁর সম্মানবোধ সত্যিই অনুকরণীয়। তাঁর সান্নিধ্যে এলে একটা ইতিবাচক অনুভূতি হয়। তার আজ ৫০, আমি তাকে আমার শুভকামনা জানাই ।
আমার মতো হয়তো আরও অনেকেই আছেন, যাঁদের কাছে দিল্লির এই যান্ত্রিক জীবনে পীযূষবাবু এক ঝলক নির্মল বাতাসের মতো, এক টুকরো সবুজ দ্বীপের মতো। তাঁর হাত ধরেই হয়তো আমার মতো কেউ কেউ সাহিত্য চর্চার আনন্দ নতুন করে খুঁজে পেয়েছে, ভিনদেশে থেকেও নিজের শিকড়ের সঙ্গে সংযোগ অনুভব করেছে। তাঁর মতো একজন মানুষের সান্নিধ্য পাওয়া, তাঁর বন্ধুত্বের বৃত্তে থাকতে পারাটা নিঃসন্দেহে এক বড় প্রাপ্তি।
Tags:
ক্রোড়পত্র