জ্যোতির্ময় নন্দী


জ্যোতির্ময় নন্দীর কবিতা



আমার ঈশ্বর 

আমার ঈশ্বর ধূলিধূসরিত, সর্বঅঙ্গে কালের প্রকোপ
দানাপানি কে যে দেয় ঠিক নেই, তবু মারে ঝোপ বুঝে কোপ
মাঝে মাঝে। তা না হলে এ আকালে ঈশ্বরত্ব রাখা হতো দায়
কারণ ঈশ্বর নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত নানা মত, নানা সম্প্রদায়--

বেতন দেয় না কেউ, সপাসপ বেত মারে ঈশ্বরের পিঠে
যতই লাগুক প্রাণে, ঈশ্বর তবুও হাসে মৃদু মিঠে মিঠে
কারণ যতই হোক-- মানুষ তো ! শ্রেষ্ঠ জীব, ঈশ্বরের পুত 
আমার ঈশ্বর তাই আজ আর ভগবান নয়-- মহাভূত

নিরালোক অন্ধ রাতে আর্তস্বর কেঁদে ওঠে-- ‘ঈশ্বর ঈশ্বর’ 
জরাগ্রস্ত মহাভূত অলক্ষ্যে তাকিয়ে থাকে নীরব নিঃস্বর
যুযূধান ভক্তকুল কোলাহলে ঈশ্বরকে করেছে বধির
তৃতীয় নয়ন তার অশ্রুতে হয়েছে অন্ধ এবং অধীর

আমার ঈশ্বর খুব অসহায়-- ভক্তকুল তাকে ভাঙে আর
গড়ে আর ভাঙে আর... চক্র থেকে ঈশ্বরের মেলে না নিস্তার


প্রার্থনা

সব শেষ হয়ে গেলে প্রার্থনাটা রাখি মনে মনে 
অতি সন্তর্পণে 

অন্য কোথাও রাখি না তাকে, পাছে খোয়া যায়
প্রার্থনা জড়িয়ে রাখি প্রাণপণে অস্থিতে মজ্জায় 

সারাদিন আমার সকল সাধ্য, সব চেষ্টা যা কিছু পারত না
সব অনুবাদ করে সন্ধ্যেবেলা বানাই প্রার্থনা

সবশেষে প্রার্থনাটা ঘুমায় আমার সঙ্গে রাতে

পরদিন প্রথম প্রভাতে
অবিচল জাগার প্রত্যয়ে 
প্রার্থনা ঘুমায় স্বপ্ন হয়ে 


 
স্বয়ম্প্রভ

সন্ধ্যেয় তার বাতি জ্বালানোর দরকার নেই
যে নিজেই জ্বলছে

সে নিজেই স্বয়ম্প্রভ, স্বয়ম্প্রকাশ 

তার কোনো দিবারাত্রির কাব্য নেই
সে যেদিকেই যায়
মানুষের চোখে চোখে জেগে ওঠে তার প্রতিচ্ছবি 
তখন কিবা রাত্রি, কিবা দিন 
আলোর রাজ্যপাট সর্বত্র সম্প্রসারিত 

নিজেকে দৃশ্যমান করতে
সে কোনো আলো জ¦ালে না
বরং নিজেই জ¦লে অভ্যন্তরীণ দাহ্য উপাদানে
শীতসকালে সূর্য আর সন্ধ্যায় আগুনের কুণ্ড হয়ে
মানুষেরা তাদের হিমেল শরীর আর
বাজরার রুটি সেঁকে নেবে বলে

কিংবা সে-আগুন থেকে মশাল জ্বালিয়ে 
পথ দেখে দেখে চলে যাবে 
রাতের ফসল পাহারায় 

শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কর্পোরেট ভবনের 
চৌকো খুপরির ঘষাকাঁচ গলে আসা
প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় কোনো আলোই সে নয়
বরং আগুন
তোমার গলবার মতো কোনো ধাতু 
আজও যদি অবশিষ্ট থাকে 
তবে জেনো সে একদিন গলিয়ে দেবেই 

ছাঁচে ফেলে কণ্ঠহার গড়ে নেবে
কিংবা বিগলিত সুবর্ণরেখা হয়ে বয়ে যাবে বলে 

অথবা কোনো এক নিষ্প্রদীপ নিরালোক রাতে
সে পবিত্র অগ্নিকুণ্ড ঘিরে জমে উঠবে
উন্মাতাল নাচের আসর 

জীবন জাগর...





সেও ছিল এক আহত বুনোহাঁস 


সেও ছিল এক
আহত পাখি
রক্তাক্ত তরুণ বালিহাঁস 

তুমি তাকে বুকে তুলে নিয়েছিলে
তোমার আপন হৃদয়ের কাছাকাছি

নিজস্ব স্বাধীনতার আকাশে সে  
অবাধে উড়তে চেয়েছিল, আর
তাই তার দু পাখা কুপিয়ে দিয়েছিল 
নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ারা

বামধারার ক্রেঙ্কারে মুখরিত
তার কণ্ঠকে রুদ্ধ করতে
তাকে এমন কোপানো হল
বাম পাখাটা কার্যত
বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল 
দেহ থেকে 

তার আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল 
ক্রেঙ্কার কলগীতির
একই স্বাধীনতার আকাশের
উড়ুক্কু মুমুক্ষু 
যূথসঙ্গীদের 
কোপানো
ছিন্নভিন্ন
মৃতদেহগুলো 

রক্তস্রোতে ভাসমান 
হংসতরুণটিকে
বুকে তুলে নিয়েছিলে তুমি
শুশ্রƒষার 
আরোগ্যের 
আশ্রয়ের 
প্রশ্রয়ের 
প্রতিশ্রæতিতে 

অবাধ স্বাধীন সঞ্চরণের 
একটা আকাশও তাকে দিলে তুমি 
হয়তো সীমিত 
তবুও নিশ্চিত 

সেই শান্ত সান্ত সীমার মধ্যে
অসীমের ডাক শোনা যায়
অনন্তের স্পন্দন পাওয়া যায় 

সীমাকে তাই মেনে নিয়েছে 
হংসযুবা 

বলা যায়, সীমার মায়ায় পড়েছে 

ক্রমশ সুস্থ হয়ে উঠতে থাকা পাখার পালকে বিলি কাটতে কাটতে তার ঠোঁটে ঠেকে সেলাইয়ের দাগ 
আর মনে পড়ে যায় তীক্ষè সেই যন্ত্রণার বোধ যা তার কণ্ঠতন্ত্রীতে নব নব সঙ্গীত হয়ে বেজে ওঠে 

তোমার শান্ত সান্ত সীমার অন্তহীন অসীমে...


কথা কোথায়


কথা বলতে চাইছো? প্রাণের কথা
কথা কোথায়? শুধুই অনর্থকতা

ঢেউয়ের পরে ঢেউয়ের মাথায় ক্রমে
কত কথার ফেনা উঠছে জমে

ভেঙে পড়তে কোথায় পাবে তট
কথা আছে, শ্রোতার সংকট

সবাই শুনতে চাইছে বটে কথা
যেসব শুধু মিথ্যে স্তাবকতা

কিংবা হচ্ছে কথা বেচাকেনার
দেয়া নেয়া এবং ধার দেনার

কথা হচ্ছে রাজনীতি ক‚টনীতির
কিছু কথা পোশাকি প্রেমপ্রীতির

কিছু কথা ধর্মরসে পুষ্ট
কিছু কথা অশ্লীলতাদুষ্ট

কিছু কথা কাব্যরসে সিক্ত
কিছু মিষ্ট, অমø কিংবা তিক্ত

জগৎ জুড়ে কথার চলাচলে
জেগে ওঠা বিপুল কোলাহলে

বলতে গেলে তোমার কিছু কথা
নেমে আসছে পাথর নীরবতা

কথা বলবে? প্রাণের কথকতা
রুদ্ধবাক শোকস্তব্ধতা 



পৃথিবী নামের জামাটা

গা থেকে টেনে খুলে 
ছুঁড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছে করছে 
পৃথিবী নামের নোংরা জামাটা 
যার পুরোটা জুড়ে লোভের তেলঝোলের দাগ
ঘৃণার থুতু, তাচ্ছিল্যের পানের পিক 
পুরোনো ক্ষতের মরা রক্তের ছোপ
তাক বুঝে কাকের হেগে দেয়ার চুনকাম 

পৃথিবী নামের ঘিনঘিনে একটা অস্তিত্ব 
আমাকে জড়িয়ে রেখেছে আজ কতদিন 
যতই তা থেকে বেরিয়ে যেতে চাই 
হিমেল একটা হাওয়া ছুটে আসে 
কোন্ অশরীরীলোক থেকে 
আর আমার শরীর কেঁপে ওঠে 
আচমকা বেপথু যেন, নিয়ন্ত্রণহীন... 

চ্যাটচেটে জামাটা তখন আবার 
ভালো করে গায়ে জড়িয়ে মড়িয়ে 
জবুথবু বসে থাকি 

কিন্তু আর কতদিন 

এখন আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত 
ক্রমবর্ধমান অসহ গুমোটে 
দুর্গন্ধে পূতিগন্ধে মনে হয় 
আমার গায়ে পৃথিবী নয় 
আস্ত একখানা নরক জড়িয়ে বসে আছি 

ধান্ধায় আছি একটা 
পরিচ্ছন্ন নতুন জামার 
পেলে ভালো
নতুবা দিগম্বর আত্মা হয়ে যাবো 
আকাশস্থ নিরালম্ব বায়ুভূত  

জামা টামা কিছুই লাগবে না 

পৃথিবীর নিকুচি করেছে 
তোমরা যাদের ইচ্ছে থাকো 
গায়ে চাপিয়ে আরো কিছুদিন এই 
আস্তাকুঁড় জামা 

আমি এটা শিগগিরই ছুঁড়ে ফেলে দেবো 
তেপান্তরের ওপারে 
যাতে তার পূতিগন্ধ থেকে পরিত্রাণ মেলে
ফিরে পাই নিরাবরণ নগ্ন আত্মার সৌরভ