চিন্ময় বসু

একটা ঠিকানা


চিন্ময় বসু



আমার সাত বছর বয়সের সময় আমাদের যৌথ পরিবার থেকে আলাদা হয়ে বালিতে অন্য পাড়াতে এসে উঠলাম । অনেক পুরনো ঘটনা । হালকা জলছবির মত মনে আসে । যে বাড়িতে এলাম সেটা একটা দোতলা বাড়ি। উপরতলাতে দুই ঘর ভাড়াটে আর নিচে সবমিলিয়ে সাতটা ঘর আর সাথে রান্না করার জায়গা ছিল। সব মিলিয়ে তিন ঘর ভাড়াটে ছিল নিচের তলায়। আজকালকারের ফ্ল্যাটবাড়ির মতো পৃথক ব্যবস্থা ছিল না । আমার মনে আছে উপর তলায় যাওয়ার জন্য দুই দিকে সিঁড়ি ছিল আর একটা সিঁড়ি আমাদের ঘরের দিক থেকে শুরু ছিল তাতে বসে আমরা ও পাড়ার অন্য বাচ্চারা খেলা করতাম । তখন সব বাড়িতেই ছেলে মেয়েদের সংখ্যা বেশী থাকতো ।

নিজের তলাতে যেভাগে আমরা উঠলাম সেখানে স্বাভাবিকভাবে পুরনো ভাঙ্গা বালতি, ফেলে দেওয়া ঝুড়ি, চপ্পল ইত্যাদি পড়ে ছিল । সবাই বাড়ি ছাড়ার সময় এই ধরনের আবর্জনা ফেলে যায় অন্য কোন ভাড়াটে নতুন জায়গাতে এসে বিশেষ কিছু খুঁজে পায় । এই নিয়ে সরস লেখক তারাপদ রায় এক মজার গল্প ফেঁদেছিলেন । উনারা একজায়গায় এসে একটা ফ্রেম করা ফটো টাঙানো পেলেন । গয়া আদালতের বার লাইব্রেরির কিছু কর্মীর গ্রুপ ফটো আর তাতে সবার নাম

ও সন তারিখ ইংরেজিতে লেখা । তারাপদ বাবু অনেক চেষ্টা করেও আগের বাসিন্দাদের সাথে যোগাযোগ করে ফটোর কথা বলাতে তারা জানালো যে ওই ফটোর সাথে তাদের কোন সংশ্রব নেই এবং তারাও যখন প্রথমে এসেছিল তখন ওই ফটোটা দেওয়ালে টাঙানো ছিল । তারাপদ বাবুর ও ফটোটার সঙ্গে বাস করতে হয়েছিল । ওই সামান্য ব্যাপার নিয়ে মজার গল্প লিখে আনন্দ দিলেন ।

ও বাড়িতে এসে আমাদেরও একটা প্রাপ্তিযোগ ঘটে, তবে সেটা কোন বস্তু নয়, একটা ঠিকানা পেলাম । ধীরে ধীরে ওই ঠিকানার মজা পেলাম । ঠিক বরদান ও বলা যায় । এই ঠিকানায়, নিয়মিত নানা চিঠিপত্র, পত্রিকা ও বই আসতে লাগলো। সেক্রেটারি বালি নীতি সংঘের নামে আমাদের ঠিকানাতে । আশেপাশের খোঁজ করে ওই নামের কোন সংঘের খবর পেলাম না । তারাপদ বাবুর মতো আমরাও পুরানো ভাড়াটিয়ার খোঁজ করতে গিয়ে জানা গেল যে সেই ভাড়াটিয়া বরানগর এলাকাতে উঠে গেছে । তার এক মামাতো ভাইয়ের বালি বাজারে মোদের দোকান ছিল । তার থেকে জানা গেলো যে তার ভাই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আরগারি দপ্তরে কাজ করে এবং সরকারি টাকা পয়সা চুরির জন্য সাময়িকভাবে বরখাস্ত আছে । সুতরাং সেই গুণী ব্যক্তি সেক্রেটারি নীতিসংঘ হওয়ার যোগ্যতা থাকলেও আপাতত তার সঙ্গে যোগাযোগের কোন সুযোগ নেই ।

চিঠিপত্রের সাথে মাঝে মধ্যে বইয়ের প্যাকেট আসতো । প্রতিবেশীরা কেউ কেউ একটু সন্দেহ চোখে দেখতো । বাবার একটা ওষুধের দোকান ছিল খিদিরপুর এলাকাতে । তাই সপ্তাহে বা দশ দিনে বাড়িতে আসতো । মা আর আমরা কভাই বালীতে থাকতাম । যাইহোক মোটামুটি ব্যবস্থা মোটামুটি স্থায়ী হলো ।

চিঠিপত্রের একভাগ আস্ত আমেরিকার প্রচার বিভাগের পুস্তিকা স্প্যান (SPAN) ম্যাগাজিন আর “আমেরিকান রিপোর্টার” । এছাড়া মাঝেমধ্যে বইয়ের প্যাকেট । আরেকভাগে আসত “সোভিয়েত দেশ”এর বইয়ের প্যাকেট । সবই বাংলা অনুবাদে , রাশিয়ার লেখা । বোধ হয় ‘ওয়ান বাই ওয়ান গুড স্ট্রিট ক্যালকাটা’ রাশিয়ান পত্রিকা গুলোর উৎসস্থল ছিল । তাই গোর্কি, টলস্টয় এবং অন্য রাশিয়া লেখকদের বই আমাদের নাগালে এসেছিল খুব কম বয়সে। অপরপক্ষে বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন ,হুইট ম্যান আমাদের বাড়িতে এসে গিয়েছিল। না না করেও অল্প পড়া হয়ে যেত বেঞ্জামিন এর আত্মজীবনী টা আমার খুব ভালো লেগেছিল । পরে জেনেছিলাম বিশ্ব সাহিত্যে এই আত্মজীবনী অন্যতম । এখনো অবাক লাগে পৃথিবীর দুই মহাশক্তি নিয়ত চেষ্টা করে যেত তাদের মতামত প্রদর্শন করে বালীর মতো গণ্ডগ্রামের এক অনামি পরিবারকে তাদের কি লাভ । এই আকস্মিক ভাগ্য লাভের ফলে আমার সাত আট বছরেই রাশিয়ার অন্তরীক্ষ ও অভিযানের বিস্তৃত খবর আর বিবরণ সুয়েজ খালের ঝগড়ার খবর একেবারে ঘরে পৌঁছে যেত। ইউক্রেনের খামারবাড়ি ও চাষিদের সুন্দর সুন্দর ছবি দেখতাম ‘সোভিয়েত দেশ’ ম্যাগাজিনে । স্প্যানজ ম্যাগাজিনে কেনেডি ক্যাশিয়াস ক্লের ( পরে মোহাম্মদ আলী ) ছবি আমাদের খুব অভিভূত করতো । তখন আমাদের সমবয়স্ক ছেলেদের থেকে আমি বোধ হয় বাইরের দুনিয়ার খবর বেশি জানতাম। আর আস্ফালনও করতাম । কেউ কেউ আমাকে অকালপক্ব বলতো ।

এই ঠিকানার দৌলতে আমার কাছে পঞ্চাশের বেশি বই জোগাড় হয়ে গেছে। বেশ কিছু বই বন্ধুদের পড়তে দিলাম যেগুলো আমার কাছে আর ফিরে এলো না । স্কুলেও ক্লাসের মধ্যে গল্পের বই নিয়ে যাওয়াতে দুটো বই বাজেয়াপ্ত হল । বন্ধুদের পৈতে নিমন্ত্রণেও বইগুলো উপহার হিসেবে ব্যবহার করেছি । ভালই চলছিল আমার এই বইয়ের কারবার তবে সবকিছু একসময় শেষ হয় । প্রায় পাঁচ বছরের মাথায় আমাদের নিজেদের বাড়িতে উঠে গেলাম , পুরানো বাড়ির সাথে ‘তার’ অবদান ত্যাগ করতে হল । কিছুদিন লাগলো অভাব বোধটা ভুলতে । এখনো আশ্চর্য লাগে আমার` অবিশ্বাস্য ভাগ্যের কথা ভেবে । বাল্যকালের সেইসব স্মৃতির কথা নিপুণভাবে ফুটিয়ে তোলা আমার সাধ্য নয় তবুও এটা একটা প্রয়াস যা ঐ সময়ের সমসাময়িকেরা হয়তো কিছুটা নিজেদের যাপন ও জীবন স্মৃতি দিয়ে অনুধাবন করতে পারবেন ।