নির্ঝর নৈঃশব্দ্য
কবি ও ফুলের মৃত্যুগান
নির্ঝর নৈঃশব্দ্য
সম্ভবত ২০০৩ সালে আমার হাতে আসে কমলকুমার মজুমদারের উপন্যাস সমগ্র। প্রথম পড়ি, ‘আলো ক্রমে আসিতেছে’ বাক্য। এ যেন বেদবাক্য। এ বাক্য দিয়েই শুরু করতে হয়। তারপর পৃষ্ঠা উলটে চলে গিয়েছিলাম ‘গোলাপ সুন্দরী’তে। প্রতিটি লাইন প্রথমবার কয়েকবার করে পড়তে হয়েছিল। তারপর আবারও পড়েছি ‘গোলাপ সুন্দরী’, আমার কাছে অমৃতের মতো লেগেছে। তারপর আবার ফিরে গেছি ‘অন্তর্জলী যাত্রা’য়। তারপর একে একে পড়েছি বাকি উপন্যাসগুলি। আরো কয়েকবছর পর পড়ি তার ‘গল্প সমগ্র’।
কমলকুমার বাঙলাসাহিত্যে স্বকীয় একটা সাহিত্যভাষা নির্মাণ করেছেন, যা ললিত কিন্তু অনেকের কাছে কষ্টপাঠ্য। আমি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের গদ্য বিশেষ করে কালীদাসের ‘অভিজ্ঞানম শকুন্তলম’-এর ভাষান্তর শকুন্তলা যে ভাষায় নির্মাণ করেছেন, সে ভাষাসৌন্দর্য আস্বাদনের অনেকবছর পর কমলকুমার পড়ে আরো সুন্দর এক ভাষাবিন্যাসের সন্ধান পেলাম যা আমাকে একটা ঘোরের ভেতর নিয়ে গিয়েছিল। এমন আশ্চর্যসুন্দর ভাষায় আমার মনে হত কেবল পৌরাণিক উপাখ্যান বা লোককথাই রচনা করা যায়। আমার সুবোধ ঘোষের নাম করতে মন করছে, তিনি মহাভারতের প্রেমোপাখ্যানগুলি নিয়ে রচনা করেছিলেন ‘ভারত প্রেমকথা’ নামের একটা গল্পের বই। তার সেই গল্পের ভাষাও ঈর্ষণীয় সুন্দর। কিন্তু কমলকুমার বললেন সাধারণ মানুষের যন্ত্রণা, প্রেম আর ক্লাইম্যাক্স। অনিলার আত্মাহুতি যতটা আমাকে আঘাত করল তারচেয়ে বেশি বাজল মনে তার মাকে অনিলার বুঝতে না পারার বেদনা।
কমলকুমারের তৈরি গদ্যভাষার সৌন্দর্য আস্বাদনের আগে আমার মনে হত এমন আশ্চর্যসুন্দর কাব্যময়, চিত্ররূপময় ভাষায় কেবল পৌরাণিক উপাখ্যান কিংবা লোককথাই রচনা করা যায়। কিন্তু তাকে পড়ে আরো সুন্দর এমন এক ভাষাবিন্যাসের সন্ধান পেলাম যা আমাকে একটা ঘোরের ভেতর নিয়ে যায়। এবং যা বরাবরই ঈর্ষণীয় সুন্দর। আমি মনে করি, তাকে পড়তে হলে পাঠক হিসেবে যথা অর্থে শিক্ষিতও হতে হবে। কারণ কেবল অশিক্ষিত পাঠকের কাছেই তার গদ্যভাষা দুর্বোধ্য ও উদ্ভট মনে হতে পারে। সম্ভবত বিষ্ণু দে বলেছিলেন ‘কমলবাবু ফরাসি সিনটেক্সে লেখেন’। হয়তো তার দীর্ঘ বাক্যকাঠামো আর অসম্পূর্ণ ক্রিয়াপদের ব্যবহার দেখে কিংবা ফরাসি ভাষায় তার পাণ্ডিত্য সম্পর্কে জেনে এই জাতীয় কথা বলেছিলেন। কিন্তু কমলবাবু তা অস্বীকার করেছিলেন নানা জায়গায়।
বাঙলাদেশে কমলকুমার মজুমদারকে নিয়ে যারা যারা রীতিমতো গবেষণা পর্যায়ের লেখালেখি করেছেন তাদেও মধ্যে একজন কথাশিল্পী কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর। তিনি ‘কথা’ নামে একটা ছোটোকাগজ সম্পাদনা করতেন। কমলকুমারের জন্মশত-বার্ষিকী সংখ্যা হবে ‘কথা’র। হঠাৎ একদিন তিনি আমাকে ফোন করলেন। বললেন যে তিনি আমার একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করতে চান কমলকুমার সম্পর্কে। আমি খুবই বিস্মিত হলাম আর সম্মানিতও বোধ করলাম। কারণ এর আগে তার সঙ্গে আমার কোনো আলাপ-যোগাযোগ ছিল না। তার মতো একজন অগ্রজ কথাসাহিত্যিক আমার মতো তুচ্ছ এক লেখককে ফোন করে কমলকুমার মজুমদারের মতো বিরাট একজন কথাশিল্পী সম্পর্কে বলার প্রস্তাব দেবেন সেটা আমার জন্য কল্পনাতীত।
সেই সাক্ষাৎকারে তার প্রশ্নের উত্তরে যা বলেছিলাম তাইই এখানে ঘষে-মেজে দিলাম।
জাহাঙ্গীরের প্রথম প্রশ্ন ছিল কমলকুমার বাঙলা সাহিত্যে অপরিহার্য কি না। আমি বললাম, সচরাচর পাঠক-সমালোচককে দেখা যায় কমলকুমার মজুমদারকে দুর্বোধ্য বলে বাতিল করতে। কিন্তু আমি মনে করি আগে তাকে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়তে হবে। সমস্ত না পড়ে তাকে বাতিলের এ প্রবণতা হঠকারিতা ছাড়া আর কিছু নয়। ফলে তার প্রতিও সুবিচার করা হয় না, আর পাঠকও তার সাহিত্যরস আস্বাদন থেকে বঞ্চিত হন। অবশ্য তাকে পড়তে হলে পাঠক হিসেবে শিক্ষিত হতে হবে সকলদিক দিয়ে। কারণ অশিক্ষিত পাঠকমাত্রই তার গদ্যকে উদ্ভট মনে করেন। তিনি অবশ্যই আমাদের সাহিত্যে অপরিহার্য। যেহেতু তিনিও বাঙলাসাহিত্যই রচনা করেছেন, স্বকীয় একটা ধারা, গদ্যশৈলীর জন্ম দিয়েছেন।
তার পরের প্রশ্ন ছিল কমলকুমারের ভাষাশৈলী নিয়ে। বললাম, কমলকুমার অনেকগুলি ভাষা জানতেন। ফরাসি তো অবশ্যই। সে ক্ষেত্রে তার বাক্যনির্মাণ কিছু ক্ষেত্রে ফ্রেঞ্চ সিনট্যাক্স হতেই পারে। কিন্তু কখনো বিষ্ণু দে বললেই যে তা সত্যরূপে প্রতিভুত হবে তাও কিন্তু নয়। শিল্পের আসলে কোনো বাঁধাধরা নিয়ম থাকতে নেই। সেটা অবশ্যই কথা শিল্পের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তাই কমলকুমার বাক্যনির্মাণের ক্ষেত্রে খুব একটা ব্যাকরণ মেনেছেন বলে মনে হয় না। তিনি ললিত ভাষার বাক্য নির্মাণ করতে গিয়ে ভেঙেছেন বিরামচিহ্নের যথার্থ ব্যবহার। সাধু-চলিত, প্রমিত-লোকজ ইত্যাদি ভাষা মিলেমিশে তার বাক্যে একাকার হয়ে গেছে। যদিও কমলকুমারের গদ্য প্রকরণবহুল, আলংকারিক, কিন্তু এর রস আস্বাদন করতে পারাটাও দুর্লভ অভিজ্ঞতা আর সক্ষমতার বিষয়।
পরের প্রশ্ন ছিল, বাঙলাদেশের মুসলমান অধ্যুষিত সংস্কৃতি রামকৃষ্ণের লোকগদ্যের অনুসারী একজনকে চর্চার ক্ষেত্রে আরও জটিল করে তুলছে কি না? আমি বললাম, পাঠকের কথা যদি ধরি, বাঙালি মুসলমান পাঠকদের মধ্যে যারা প্রকৃতঅর্থে শিক্ষিত তাদের কমলকুমার পাঠে জটিলতার মধ্যে পড়ার সম্ভাবনা তেমন একটা নেই। আর যারা অর্ধশিক্ষিত তাদের অন্যত্র পড়াশোনা হলেই হয়ে যায়। তাই গভীরতর সাহিত্যপাঠ মূলত তাদের কর্ম নয়। ফলে কমলকুমারের গদ্যে শ্রীচৈতন্য দেব বা গীতিকবি রামপ্রসাদ সেন কিংবা ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসের ভাবাদর্শ যতই থাক তা শিক্ষিত মাত্রই সিনথিসিস করতে পারেন। আর বাঙলার মুসলমান অধ্যুষিত সংস্কৃতি আসলে কী? মুসলমান মিশনারি কিংবা দখলদার শাসকরা এই অঞ্চলে অনুপ্রবেশ করার আগে এই অঞ্চলের মানুষের সংস্কৃতি মানে জীবনাচরণ কেমন ছিল? আসলে বাঙালি মুসলমান যেমন সংকর, তার সংস্কৃতিও সংকর। লোকায়ত ভাব এই অঞ্চলের মানুষের রক্তের ভেতর বহমান, সে যতই টান টান, নির্মেদ বা খোলস বদলে নিক। আর চর্চা বলতে আপাতত পড়াশোনাকেই বুঝতে চাই। কমলকুমারের লেখায় মূলত লোকায়ত দেবী কালী এবং যিনি নিজেকে তার অবতার বলে দাবি করতেন সেই রামকৃষ্ণ পরমহংসের প্রতি ভক্তিই বিদ্যমান। এর বাইরে সমস্তই তিনি মানুষের যাপিত জীবনের কথাই বলেছেন। মধ্যবিত্ত আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সাব-অল্টার্ন মানুষ।
আরেক প্রশ্নে জাহাঙ্গীর আমার মতামত চাইলেন যে উত্তর-ঔপনিবেশিক সময়ে ঔপনিবেশিক সাহিত্যমগ্নতা কি কমলকুমারের মানসিকতা মূল্যায়নের একটা প্রধান অন্তরায় হতে পারে? আমি বললাম, যতই উত্তর-ঔপনিবেশিক বলি আসলে কি তা হতে পেরেছি আমরা? এর লক্ষণ কী? আমি মনে করি এখনো আমরা মানসিকতায়, অনেকক্ষেত্রে জীবনাচারে ঔপনিবেশিকই আছি। দোকানপাটে ইংরেজি সাইনবোর্ড ইত্যাদি। ইংরেজি অবশ্যই জানার দরকার আছে। তবে এই যে আজকে কেউ ইংরেজি বলে নিজেকে বিরাট কিছু মনে করেন, বাঙলা বলাটাকে লজ্জাজনক মনে করেন এইটাও তার একটা ঔপনিবেশিকই আচরণ। আর সাহিত্যে তো আমরা ঔপনিবেশিক অবশ্যই, এখনো পশ্চিমা নন্দনতত্ত্ব দিয়েই ঠিক করি আমাদের সাহিত্যের বিন্যাস। তাহলে তো কমলকুমারকে মূল্যায়নে এটা অন্তরায় হবেই।
তারপর কমলকুমারের সঙ্গে তার ভাষা, বিশেষত ভাবদর্শনে রামকৃষ্ণ-রামপ্রসাদের বিষয় নিয়ে বলতে গিয়ে বললাম, কমলকুমারের পাঠক আলাদা। সে ওপার বাঙলাতেই হোক কিংবা এই বাঙলাতেই হোক। পশ্চিমবাঙলায় যে সকলে তাকে পাঠ করেন তা কিন্তু নয়। ওখানেও কিছু সংখ্যক পাঠকই, যারা কৌত‚হলী, শিক্ষিত কিংবা রূপ-রস আস্বাদি। একটা কথা বেশ প্রচলিত, কমলকুমার হলেন লেখকের লেখক। এটা অনেকাংশে সত্যি জেনে খোঁজ করলে দেখা যায় যারা কমলকুমার পড়েন তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোনো না কোনো ভাবে সৃজনশীল লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত। আর কমলকুমার পাঠের জন্য আলাদাভাবে রামপ্রসাদ সেন কিংবা রামকৃষ্ণ পরমহংসের ভাবাদর্শ ধারণ বা চর্চা করতে হবে বলে আমি মনে করি না। তবে বুঝতে হবে। তিনি প্রায় সর্ববিষয়ে শিক্ষিত ছিলেন এটা বলা বাহুল্য। তার সময় অর্থাৎ পঞ্চাশ কিংবা ষাটের দশকে বাঙলাসহ সারা পৃথিবীতে শিল্পসাহিত্যে অনেকগুলি আন্দোলন হচ্ছিলো। তা সত্ত্বেও তিনি যে সকলকিছুর প্রভাব এড়িয়ে মূল আঁকড়ে ধরেছিলেন, পাশ্চাত্য নন্দনতত্ত্ব, ভাষা কাঠামো তথা ব্যাকরণকে অনুসরণ না করে এই অঞ্চলের শাস্ত্রাবলি, নন্দনতত্ত্ব, লোকাচার, ধর্মকে আশ্রয় করে সাহিত্যে একটি ভিন্ন ভাষাকাঠামো নির্মাণে সচেষ্ট হবার সাহস দেখিয়েছিলেন কেবল সেই জন্য তাকে আমাদের স্মরণ করা উচিত।
এই তো গেল কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরের সঙ্গে কথা বলার কথা। এবার ‘গোলাপ সুন্দরী’ নিয়ে বলি। এটা প্রথমে ‘এক্ষণ’ পত্রিকায় প্রকাশ হয়। পরে বই আকারে প্রকাশ হয়। কমলবাবু এইটাকে গল্প হিসেবেই লিখেছিলেন। তো, এইটা একটা বড়ো গল্প। অনেকে এইটাকে নভেলা বা নভেলেট বা উপন্যাসিকাও বলেছেন। তবে এটা কমলকুমার মজুমদারে উপন্যাস সমগ্রে কেন রাখা হয়েছে জানি না।
‘গোলাপ সুন্দরী’র সময়-কাল ধরা যাক, দেশভাগের আগে বা পরে। যদিও এই গল্পে ওইসবের কোনো ছাপ নেই। এই গল্পে মূল চরিত্র দুইটি। কেন্দ্রীয় চরিত্রের নাম বিলাস। নবীন যুবক। দেখতে রাজপুত্রের মতো অতিশয় রূপবান, রাধিকার মতো চোখ, চোখের রং কালো। অনেকটা কবিস্বভাব, সংবেদনশীল, অন্তর্মুখী, তৎকালীন দুরারোগ্য ব্যাধি যক্ষায় আক্রান্ত। টিবি স্যানোটোরিয়াম থেকে ফিরে একটা স্বাস্থ্য নিবাসে বসবাস করে, যা একটা বাগানবাড়ির মতোই, যেখানে বেশ কয়েকটি কটেজ আছে, যেখানে গাছপালার সঙ্গে গোলাপ বাগানও আছে।
বিলাস প্রিয়তম মৃত্যুচেতনার ভিতরেই বাগানে গোলাপ ফোটায়, বিশেষত একটি গোলাপ, যার রং ঠিক কেমন লাল হবে তা তার কাছে অজানা, যে-গোলাপ ফোটার জন্যে নির্দিষ্ট হয়ে আছে এক নারী। যে-নারী অমৃত রতি ও সৌন্দর্যে দিয়ে স্রোতস্বিনীরূপে রাত্রির ভেতর এক লহমায় তাকে সমস্ত প্লাবিত করে।
দ্বিতীয় চরিত্রের নাম মনিক চ্যাটার্জি। অপূর্ব সুন্দরী, দারুণ স্কলার। অবিবাহিত। সেন্ট স্কুলের হেডমিস্ট্রেস। বয়সে তরুণীই বলা যায়। বটের ঝুরির মতো দীর্ঘ চুল। কলকাতা থেকে এসে একই স্বাস্থ্য নিবাসের বিলেতি কটেইজে মানে মিয়ানার লিলি কটেইজে উঠেছেন। কারণ তারও অসুখ। তার অসুখটিও তৎকালে দুরারোগ্যই ছিল বলা চলে। অসুখের নাম বেরি বেরি।
বিলাস ও মনিক প্রথম পরস্পরকে যথাঅর্থে দেখে বিলাসের গোলাপ বাগানের বেড়ার ধারে। সেইদিনই বোধকরি পরস্পরের প্রতি সদর্থক ব্যাপার তৈরি হয় মনের ভেতর। তারপর মনিকের সঙ্গে বিলাসের প্রথম দেখা হয় এক ঝড়ের রাতে। মনিক শহরে গিয়েছিল কাজে। ফিরতে ফিরতে রাত্রি। রাত্রিতে ঝড়-বৃষ্টি, বজ্রনিনাদ আর বিজলির চমক। পথিমধ্যে বিলাসের কটেইজ, এই কারণে মনিক ঝড়বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্যে বিলাসের কটেইজে ঢুকে পড়ে। তারপর গোলাপ, ক্রন্দনের ভেতর গোলাপ সুন্দরীর জন্ম হয়, এইসকল আলাপের পর বাতাসের টানে বাতি নিভে যায়, ঘটনাক্রমে স্পর্শ আর ঘ্রাণের টানে পরস্পর মিলিত হয়, রচিত হয় মহাকাব্যিক এক বিস্তার। আর ঝড়ের শব্দ পালটে যায় মেঘমল্লারে। তবে অকস্মাৎ এই রতিসঙ্গ যেহেতু পূর্ব পরিকল্পিত বা চেতনায় ছিল না, সেহেতু এই মিলন দুজনের পক্ষেই অযাচিত ছিল। ফলে পরস্পর অস্বস্তি, গ্লানি তৈরি হল, বেজে উঠল বিচ্ছেদের বাঁশি।
এইবেলা আমরা ‘গোলাপ সুন্দরী’ গল্পের শেষটা পড়ি,
‘এমত সময় একটি টাইপ করা চিঠি আসিল, এখন সে চিঠি খুলিল।
চিঠিতে সনির্বন্ধ অনুরোধ ছিল, এবং গোলাপ সুন্দরীর খবর ছিল, যে তিনি একটি পুত্র রাখিয়া মরিয়াছেন। আঃ মনিক! একবার বিলাসের মনে হইল, যাঁহাকে সে প্রথমে পবিত্র শুদ্ধ বস্ত্র পরিধান নিমিত্ত দেয়, তিনি বলিয়াছিলেন ‘আমার মা, পাগল ছিলেন’ এবং একথা শ্রবণে তখন সে, বিলাস, বাহিরের মহাপ্রলয় দেখে ।
বিলাসের নিশ্বাস দুর্বল হইয়া আসিয়াছিল তথা আর কয়েকটি নিশ্বাস মাত্র সম্বল এ কারণে দীর্ঘ নিশ্বাস তাহার ছিল না। শুধু ইতিমধ্যে, সম্ভবত, মনে হইল মৃত্যুকে অমোঘ করিবার জন্য পুনরায় সে শিশু হইতেছে।’
এই শেষাংশটা মনিকের সঙ্গে বিচ্ছেদের অনেকদিন পার হবার পর। তা এক বছরও হতে পারে। এই অংশের চিঠিতে জানতে পারি, একটা পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়ে মনিক চ্যাটার্জির মৃত্যু হয়েছে। ধরে নিই এই সন্তান বিলাসেরই ঔরষজাত। গল্পের শেষ অনুচ্ছেদে সম্ভবত চিঠি পাঠের পরই বিলাসের মৃত্যুর কথা বলা আছে। সে মৃত্যুকে মহিমা দেয়ার জন্যে পুনর্বার শিশু হচ্ছে মানে এই শিশুর মধ্যে আমি মনিকের সেই পুত্র সন্তানের মুখই দেখতে পাই।
এইবার গল্পের শুরুটা পড়ি, ‘বিলাস অন্যত্রে, কেননা সম্মুখেই, নিম্নের আকাশে, তরুণসূর্য্যবর্ণ কখনও অচিরাৎ নীল, বুদ্বুদসকল, যদৃচ্ছাবশতঃ ভাসিয়া বেড়াইতেছে।’ এটা ‘গোলাপ সুন্দরী’র প্রথম বাক্য। এখানে লেখক একটা দৃশ্য আঁকলেন, যার দর্শক বিলাস নামের একজন যুবক, কিন্তু সে নির্লিপ্ত ঘটমান দৃশ্যের প্রতি। কমলবাবুর লেখার একটা বৈশিষ্ট্য হল, পরিবেশের তিনি সকলকিছুর খুঁটিনাটি বর্ণনাও দেন। কিন্তু চরিত্রগুলিকে আঁকেন সিঙ্গেল লাইনে। এমনকি সংলাপে বাক্যও শেষ করেন না, ক্রিয়াপদ অসমাপ্ত থেকে যায় মানে পাঠকের কল্পনার ভেতর ডট দিয়ে ছেড়ে দেন। আমরা জানি যে কমলবাবু একই সঙ্গে একজন চিত্রীও। ফলে তিনি আসলে ছবিকেই লেখেন। তার বর্ণনার চিত্ররূপময়তা বাক্যের খাঁজে খাঁজে দৃশ্য হয়ে ধরা দেয়।
বিলাসকে আমার কাছে একজন কবিই মনে হয়, তার ভেতর যে একজন কবি বসত করে তা শুরুতেই প্রথম অনুচ্ছেদের দ্বিতীয় বাক্যে আমরা জানতে পারি। এই বাক্যটা বেশ দীর্ঘ। এই এক বাক্যেই বিলাসের মনোদৈহিক একটা অবস্থার কথা অনুমান করা যায়।
শুরুতে বিলাসের যক্ষা জেনে বুঝতে পারি তার পরিণতি। যেই কালে কমলকুমার এই আখ্যান রচনা করেছেন সেই কালে যক্ষা প্রাণঘাতী, প্রবাদই ছিল, ‘যার হয় যক্ষা, তার নাই রক্ষা।’ তাই পড়তে পড়তে বিলাসের মৃত্যুর প্রতীক্ষার সঙ্গে তৈরি হয় একজন গোলাপ সুন্দরীর প্রতীক্ষা। একদিন বিলাসের গোলাপ গাছে কুঁড়ি আসে, যেদিন মনিক বাগানের পাশে এসে মুহূর্তের জন্যে দাঁড়ায়। যেন তার এই বাগানসংসর্গের কারণেই এই আশ্চর্য কুসুমায়ন। এই গোলাপের উত্থান, হাওয়ার স্রোতে মনিকের রমণীয় ঘ্রাণ বিলাসের জীবনতৃষ্ণা আর কামনাকেই প্রলম্বিত রূপ দেয়। মনিকের আগমনের পরপরই জেনে যাই তারও বেরি বেরি রোগ। এইভাবে তারও মৃত্যুর গন্ধ পেয়ে যাই।
শুরুতেই বলেছি ৩ সালে কমলকুমার পড়া শুরু করেছিলাম, ‘আলো ক্রমে আসিতেছে’ এই বাক্য দিয়ে। তারপর পড়া শুরু করি ‘গোলাপ সুন্দরী’ দিয়ে। আর মনিক চ্যাটার্জির কণ্ঠে ‘আলো নিভে গেছে’ এই বাক্য শুনে গোলাপ সুন্দরীর মধ্যে ডুবে যাই। আশ্চর্য বিস্ময়ে পড়ি তৃষ্ণার সৌন্দর্য, ‘এইভাবে খুঁজিতে খুঁজিতে যে হাতে বিলাসের একদা কাঁটা ফুটিয়াছিল, যে হাতে গ্রন্থ ধরিয়া শ্লোক পাঠ করে, সেই নিমিত্তমাত্র হাতে, উষ্ণতার স্পর্শ লাগিল মানবীর দেহ অথবা নিশ্বাস। বাষ্পসম্ভ‚ত মেঘ, মেঘ উৎপন্ন আলোকে, ভাস্কর্যের বিপুলতা বিলাস দেখিল। এইটুকু দেখা লইয়া তাহার মনে হয় যে ঘুম ভালো।’ ঝড়ের রাতে অভিসারের সেই রোমহর্ষ অনুভূতি নিয়ে আমি পড়ি, ‘আমাকে ছেড়ে যেও না, আমি ভীত’ এবং ইহার পর মাথা নত করিয়া মনিক বলিতে চাহিয়াছিলেন যে শুদ্ধ বস্ত্র পরিবর্ত্তনকালে আলো নিভিয়া যায় ফলে...। মনিকের কথার উত্তরে বিলাস গভীর কণ্ঠে বলিল ‘গোলাপ সুন্দরী’ এ কথা সত্যই অনুক্ত ছিল, সে কেবল মাত্র তাহার দিকে চাহিয়াছিল । পুনরায় মনিকের কণ্ঠস্বর ‘গোলাপের মধ্যে আমারই ক্রন্দন, যে কান্না আমি বহুকাল ধরে কাঁদছি। তোমাকে আমি...’ ইহার পর মুহূর্ত্তের জন্য দুজনকে পরাজিত করিবার চেষ্টা করিল, একে অন্যের দেহের সুমধুর আনন্দধারা নিঃশেষ করিয়া শুষিয়া লইতে চাহিল। সহসা অশরীরী বজ্রাঘাতে দুইজনেই বিক্ষিপ্ত হয়। সহসা যেমত পাখী ডাকিয়া উঠিল, লজ্জা আসিল ।’
কারো মতে ‘গোলাপ সুন্দরী’ তার ভালো রচনাগুলির মধ্যে পড়ে না। কিন্তু আমি তো গবেষক নই। আনন্দপাঠে আমার মাথার ভেতর যতটা ধরেছে গোলাপ সুন্দরীর বাক্যপরম্পরা রক্তের ভেতর ঢুকে গেছে। যেন আমিই বিলাস, যক্ষাতুর কবি, হাসপাতাল থেকে ফিরে আপন বাগানে ফোটাচ্ছি আশ্চর্য সব গোলাপ। হতে পারে এই বইটির ভাষা কমলকুমারের অন্যান্য ফিকশনের ভাষা থেকে তুলনামূলকভ সহজ, তাই সহজেই আপন মনে হয়।
বিলাস তার বাগানে গোলাপ ফোটায়। এইখানে গোলাপ মূলত জীবনের প্রতীক বেঁচে থাকার প্রেরণা, মৃত্যু থেকে জীবনের দিকে যাওয়ার অমোঘ বাহন, থ্যানাথোস ভেঙে এই গোলাপ হয়ে উঠতে চায় লাইফ-ড্রাইভ। গোলাপকে আমরা দেখি, বিলাস তথা লেখক রক্তমাংসে রূপ দিচ্ছে, আর গোলাপ মনিক চ্যাটার্জিরূপে হয়ে উঠছে গোলাপ সুন্দরী, এই গোলাপ সুন্দরীই ইরোস। এই যে অত্যাশ্চার্য পার্সোনিফিকেশন এইটা সম্ভব হয় কখনো বেঁচে থাকার একপ্রকার উদগ্র বাসনা থেকে। শেষে দেখি বিলাস দীর্ঘশ্বাস জমিয়ে রাখে, কারণ তাকে নিশ্বাস নিতে হবে আরও কিছু সময় বেঁচে থাকার জন্যে। গোলাপ তার পূর্বাপর অনেক রচনাতেও প্রায় একই ভাবে আমরা আসতে দেখি। যেমন ‘অন্তর্জলী যাত্রা’র এক জায়গায় পড়ি, ‘আর যে এই ক্ষণেই তিনি মানসচক্ষে অবলোকন করেন, কাহারা যেমত বা এক মধুর গীত গাহিতে গাহিতে আসিতেছে, ইহাদের স্বেদ নেই, ইহারা ক্লান্ত নহে, যে-গীতের মধ্যে আশা, যে-আশার মধ্যে গোলাপের গন্ধ, যে-গোলাপগন্ধের মধ্যে বাল্যকাল, যে-বাল্যকালের মধ্যে নিরীহতা, কাহার অন্তরীক্ষ আলেখ্য বহনে গর্বিত।’
কিন্তু বিলাস নিজেই কখনো মনে করতো জীবন ক্ষুদ্র, শিল্পই ব্যাপ্ত। সে তার ডায়েরিতে এই জাতীয় কথাও লিখে রেখেছিল। তার যক্ষা সত্ত্বেও তাকে সিগারেট খেতে দেখা যায়, হয়তো মদও খায়। মনে করা যেতে পারে সে নিজেই শিল্প যথা রতি, কবিতা, নারী, গোলাপ ইত্যাকার সৌন্দযর্কে মহিমান্বিত করে মৃত্যুকে টান দিয়ে নামিয়ে এনে চাদরের মতো গায়ে জড়িয়ে নেয়। ফলে তার দীর্ঘশ্বাস জমিয়ে রাখাও একার্থে খেয়ালই মনে হয়। এইভাবে কবিতা আর গোলাপের আশ্চর্য প্রস্ফুটন, আপাতচোখে বাঁচার বাসনা, জমিয়ে রাখা দীর্ঘশ্বাসের পরও পরপর মৃত্যু এসে ঢেকে দেয় গোলাপের বাগান। তো বলা যায় ‘গোলাপ সুন্দরী’ মূলত কবি ও ফুলেরই নিশ্চুপ মৃত্যুগান।
Tags:
গদ্য