সমীর ভট্টাচার্য
সাহিত্যে অশ্লীল বলে কিছু নেই
সমীর ভট্টাচার্য
"*শব্দ যখন তীক্ষ্ণ ভিষণ, লেখনী তখন গরাদ ভাঙ্গে ; সভ্য সমাজ পিছু হটকায়, কলম যখন সত্য জানে*!"
জৈবিক প্রেরণা ও ধর্মজ্ঞান সমন্বয়ে যখন সম্মানিত, অসীম তখন জীবকে মানুষ বলে চিহ্নিত করে| এই স্বীকরণ মজ্জাগত শিক্ষা, যেটা রুচি এবং ভৌগলিক বিন্যাসের উপর নির্ভর শীল| জৈবিক প্রেরণা যখন আত্মজ্ঞান দ্বারা পরিচালিত, সামাজিক শ্বাপদ তখন ছোবল মারেনা বুকে| ধূঁয়া তোলেনা ধূনোর| এক আকাশ নক্ষত্র দেখে মোহিত হই| উলঙ্গ আকাশে যখন মেঘের আবরণ আসে তখন স্ব খেদে মেঘকেই গালাগাল দিই| সমুদ্রের সফেন নগ্ন ঢেউ বালুচরি মানুষকে মুগ্ধ করে| যেমন মুগ্ধ হয় কোনারকের নাগপাশে বন্দি পুরুষ নারীর বহুলতায় দেখে| নগ্নতার বিচারে বারো বছরের শিশু - বালিকাকে আকন্দ ফুল দিয়ে পাঠাই লিঙ্গ পূজো করবার জন্য --রমণের প্রথম পাঠ এ ভাবেই ভারতীয় দর্শন আমাদের কাছে এগিয়ে এনেছে ।
লাঙলের ফাল থেকে যা উঠে আসে, তা সীতা| কৃষি যদি কৃষ্টি হয়, কালটিভেট যদি কালচার হয়, তবে মেনে নিতে হয় -সৃষ্টির প্রথম পর্ব সংস্কৃতির আকাশ| ক্রমে তা' গর্ভবতী হয়| যেমন আকাশ গর্ভবতী --তারায়| নদী গর্ভবতী --মীণে| যারা 'অপ' নামে এক শব্দ আবিষ্কার করেছেন তাঁদের কাছে অপ --জল, অপ --নিন্দা, অপ --বিকৃতি| জল সংস্কৃতি, নিন্দা সংস্কৃতি, বিকৃতি সংস্কৃতি; এ এক কিংভূত সাইবেরিয়ার হিমশীতল নীল পাখির কন্ঠে, লাল ডোরা দাগের মতোই বেমানান| অনন্তের পুষ্প-বাসরে ময়ূরাক্ষীর উচ্ছ্বাস যদিও বা মানায়, গঙ্গার অপাপবিদ্ধ পবিত্রতা ঠাকুরমার ঝুলিতেই ভালো লাগে| অব্যয় দিয়ে বুদ্ধির ব্যায় নিরর্থক| বিশ্ব কবি গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ বাঙালিকে একটা উপহার দিয়েছেন --সংস্কার জনিত কুৎসিত প্রভাব থেকে; প্রচ্ছন্ন করে বলতে গেলে কুৎসা থেকে সরে এসে সাহিত্য করুন|
সাহিত্য : সৎ - চিৎ - আনন্দসদয়| যা সৎ তা অবশ্যই সত্য| যা সত্য তা অবশ্যই স্পন্দিত| যার প্রাণ আছে সে নিশ্চয়ই সুন্দর| ক্ষয়ে যাওয়া কৃষকের বুকের রিট গুলো, চোয়ালের হাড় গুলো কুঠারাগত চক্ষুর অস্তিত্বে যদি স্বকীয়তায় সাহিত্য স্ব ধর্মীয় হয়, যদি মারমুখ মিছিল ভয় পেয়ে পেছন ফেরা হয়, তাহলে নীতির দিক থেকে সাহিত্যের কোন বাঁধন নেই। তার পেছন এবং সামনে দুটোই বলতে হয়। জননীর শব্দার্থ যদি জনি হয়, আর জরায়ুর শব্দার্থ শুনে যদি কানে আঙ্গুল দিতে হয়, তবে বলতে ইচ্ছা করে; সাহিত্যে এক রকম গিলেটিন পাওয়া যায়, যার নাম ' ইতরামি ' ছাড়া আর কিছুই নয়|
একটি নারীকে যদি সাতজন পুরুষ ধর্ষণ করে, তার জরায়ু চিরে রক্তের রঙ কালো চাপ চাপ যা ঊরুতে এবং শুভ্র সায়ায় কুমারীর মলাটের মতো; লেখক যখন এ' সত্যতাকে স্বীকার করবেন, তখন কোন্ কুৎসিত প্রলোভনে তাকে জীবনের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে বলা যায় ? নির্জন ঝিলে সাঁওতাল রমনীর নগ্ন শরীর প্রক্ষালন যদি শিল্পীর তুলিতে চলে আসে, কোন্ অভিধান থেকে বলা যেতে পারে এটা সুন্দর নয় ?
অশ্লীলতা বা নগ্নতা কাকে বলে জানিনা। ভাই যখন ভাইয়ের বুকে খন্জ্ঞর মারছে তখন তা' নিঃসন্দেহে নগ্ন| মা যখন নিজের গর্ভ থেকে জন্ম দেবার পর নিজের মেয়েকে ই, টাকা রোজগারের জন্য বসিয়ে দিচ্ছেন পথে, নিশ্চয়ই তা অশ্লীল! --এই ঘটনা, এই সত্যতা সাহিত্যে উপেক্ষার বিষয় বস্তু হতে পারেনা| এড়িয়ে পালিয়ে না গিয়ে, পেরিয়ে এসে হৃদয় দিয়ে বিচার করবার --রাজ নীতির নগ্নতা সাহিত্যে যায়গা পেলে, তা কখনই অশ্লীল হয়ে যায় না| জৈবিক লালসা জীবন মূল্যেরই চাবি কাঠি|
প্রসঙ্গ উত্থাপনে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথকে আজ মনে পড়ছে| বাঙালি বিদগ্ধ জনদের কাছে সাহিত্যের বিশ্ববিদ্যালয় একমাত্র রবীন্দ্রনাথই| তাই অশ্লীল বা নগ্নসহিত্য কেন্দ্রীভূত বিতর্কের আগাজ এর ইতির চেষ্টা তাঁকে দিয়েই করবো| যে সমস্ত বিদগ্ধজনেরা সাহিত্যে স্খলিত বাসনার রূপ দেখে আঁতকে ওঠেন তাঁদের উদ্দেশ্যে বলি ---রবীন্দ্রনাথের "বিবসনা" কবিতায় বিবসনার রূপ দেখার জন্য কবি আকুল হয়ে বলেছেন, "ফেলোগো বসন ফেলো ঘুচাও অঞ্চল"|
রবীন্দ্রনাথের যৌনতা প্রকাশের আর একটি উদাহরণ---
"যৌবন রাশি টুটিয়া লুটিতে চায়
বসনে শাসনে বাঁধিয়া রেখেছো তায়
তবু শতবার শতধা হইয়া ফুটে
চলিতে ফিরিতে ঝলকি ছলকি ওঠে"।
এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের 'বোষ্টুমী' গল্পে নায়িকার ছেলে মারা যাবার পর সে গুরুকে আশ্রয় করেছিল| 'ভিজা কাপড়ে তার সঙ্গে দেখা হওয়াতে লজ্জায় একটু পাশ কাটাইয়া চলিয়া যাইবার চেষ্টা করিতেছি। এমন সময় তিনি আমার নাম ধরিয়া ডাকিলেন। বলিলেন, তোমার দেহ খানি সুন্দর"…।
রবীন্দ্রনাথের শেষ গল্পগ্রন্থ 'তিন সঙ্গি'র 'রবিবার' গল্পে মেয়েদের শরীর সম্পর্কে বিভাকে অভিক বলেছে -- "তোমাদের ভগবান যদি সাম্যবাদী হতেন তাহলে মেয়েদের চেহারায় এত বেশী উঁচুনীচু ঘটিয়ে রাস্তায় ঘাটে এ রকম মনের আগুন জ্বালিয়ে দিতেন না"
সত্তরের ঘরে দাঁড়িয়ে কবিতার পরিনত কলমে তিনি শেষ উপন্যাস লিখলেন 'চার অধ্যায়'| উপন্যাসে সরাসরি বলেছেন … "এলা যখন তার বুকের জামা ছিঁড়ে ফেলে অতীনের সামনে এসে দাঁড়ালে 'নোংড়া হাত লাগতে দিও না আমার গায়ে , আমার এ দেহ তোমার।'…
সাহিত্যের অশ্লীলতা, নগ্নতা নিয়ে যাঁদের এত বেশি মাথাব্যথা ; এক নির্লজ্জ প্রস্তাব তাঁদের কাছে রাখছি --রতি ক্রিয়ার থর-থর বর্ণনা কি আশ্চর্য্য রোমান্টিক হতে পারে, তার ইঙ্গিত বাহ পংক্তি আদীম স্ফুরিত নিঃশ্বাস নিয়ে কাব্যনাটক "চিত্রাঙ্গদা" য় খুঁজে পাওয়া যায়| সঙ্গম যে দেহভোগ একথা রবীন্দ্রনাথ সরাসরি এ কাব্যনাটকে নিয়ে এসেছেন| রবীন্দ্রনাথের "যোগাযোগ" উপন্যাসের একটি অংশ এই রকম --'কুমু … বিছানা থেকে বেরিয়ে এসে বললে, 'আমাকে অপরাধী করো না'।
মধুসূদন গম্ভীর কণ্ঠে বললে, 'কি চাও বলো, কি করতে হবে' ?
--কুমু বললে, 'শুতে এসো'।
স্বামী-স্ত্রীর চিরাচরিত শয়নকালীন সম্ভোগ এই পরিচ্ছদ এর মধ্যে কি পাই না ? এই উপন্যাসের প্রগলভ শ্যামা --'সে কুমুর চেয়ে কম সুন্দরী কিন্তু ওর চোখ, ওর, চুল ওর রসালো ঠোঁট'।
এই 'রসালো' শব্দটিতে কবির কামনা আক্রান্ত হৃদয় কি উন্মুক্ত হয় না ?
দেহ রূপ যেখানে বাসনার আগুন জ্বালে, বীভৎস ক্ষুধা যেখানে নরকীয় -সেখান থেকে শিল্পীর কলম কী ভাবে ফিরে আসে! বিশ্ব বিখ্যাত শিল্পী পিকাশোর "গের্নিকা" কি শিল্প নয় ? প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে দেখলে --তা উলঙ্গ| ক্লান্ত মাঝি কিংবা ঘর্মাক্ত শ্রমিক সাহিত্যের উপাদেয় সন্দেহ নেই ; কিন্তু বিশ্ব মানচিত্রে ভারতীয় অস্তিত্ব সৃষ্টির আদি সত্যেই সমাসীন| রাজসভায় কুলবধূর কাপড় খুলে নেওয়া ও মহাকাব্যের অংশ বিশেষ --এ কথা কেমন করে অস্বীকার করা যায় ! একটি নারীর পাঁচটি ভাতার যদি কাব্য সুষমা থেকে সরে না যায়,
অ-বিবাহিতা কুমারীর ত্যাজ্য পুত্র যদি স্বসম্মানে কুরু সনাপতি হতে পারেন -- তবে সাহিত্যে নগ্ন ব্যপারটা কি রকম ? স্তন, যোনি, জঙ্ঘা এবং লিঙ্গ পূজোয় অভ্যস্থ জনের সতীপনা -- ঘরের বৌ এর কাছেই মানায়|
সাহিত্য একটি পাত্র, যা সময়কে ধরে রাখে|
সময়ের রুচিতে যদি অরুচি নাহয়, তাহলে সাহিত্যকে দোষ দিয়ে লাভ নেই| আমার বিশ্বাস সাহিত্যে কোন বিষয় তৈরি থাকেনা| বাইরের জগতের বিন্যাস যা আমার মনের আবেগ কে ছুঁয়ে যায় কিংবা বুদ্ধিগ্রাহ্য তার যথার্থ চিত্রায়ণ নিশ্চয়ই নগ্ন| কারণ সাহিত্য সত্যের ভাষ্যকার| আর সত্য চিরকালই নগ্ন| যেকোন পরিবর্তনই উলঙ্গ| অভ্যস্থ কায়দায় প্রচলিত নিয়মকে ভেঙে ফেলা যায়না| শিল্প ও সাহিত্যের বক্তব্য উলঙ্গ বলেই লেনিনের রুশ ভূমিতে জীবনের প্রতিশ্রুতি শুনে ছিলাম, মায়াকভোস্কির সরাসরি সত্য, গোর্কির খোলাখুলি বক্তব্য বিশ এবং তিরিশের যুগকে আজও মনে করায়| স্মরণের পৃষ্ঠা উল্টালে দেখি সারখিয়ালোরকাকে|
আসল কথা, বিষয় বস্তুকে নগ্ন না করে দেখালে, বোঝানো যায়না বিষয়টি কেমন| সেই জন্যই প্রয়োজন হয় প্রেমের পাশে পবিত্র ঘৃণার| ভালোবাসার কোলে উলঙ্গ রক্ত যা রিয়ালিটিকে ছুঁয়ে থাকে| সাহিত্যের লক্ষ্যই তাই --এক চোখে তার উলঙ্গ কৃপাণ, কামনার বহ্নি ; অন্য চোখে ত্যাগের নিশান, জীবনের স্বপ্ন|
Tags:
গদ্য