সমরেন্দ্র বিশ্বাস
আই ছিং – এর কবিতা
সমরেন্দ্র বিশ্বাস
কোন একটা কয়লাখনি থেকে একজন শ্রমিক চিঠি লিখেছে – ‘আমি কবিতা বুঝি না। যখন আপনার কবিতা পড়ি, তখন যে গাঁয়ে আমার জন্ম, সেই ছেলেবেলার গাঁয়ের স্মৃতি আমার মনে পড়ে। গাঁয়ের জন্যে আমার মন দুঃখে ভরে ওঠে। …… কবিতার এ কি যাদু? যাদুর এ কি শক্তি? ……’
এই ধরণের অসংখ্য চিঠির প্রাপক আই ছিং। সাধারণ পাঠকদের কাছ থেকে পাওয়া এই স্বীকৃতিই প্রমাণ করে – কবির কবিতা লেখা সার্থক।
আই ছিং তৎকালীন চীনের একজন জনপ্রিয় কবি। জন্ম ১৯১০ সালে। চেকিয়াং প্রদেশের এক জমিদার পরিবারে। কৈশোর কাটে তার গ্রামেই। তারপর পড়াশুনা ফ্রান্সের প্যারিসে। ১৯৩২ নাগাদ তিনি যখন ফেরত এলেন, তখন চীনে চলছে জাপানী আগ্রাসন। চীনের তখন প্রায় বিধ্বস্ত অবস্থা। এইসব ঘটনা আরও অনেকের মতো তাকেও তীব্র ভাবে রাজনৈতিক সচেতন করে তোলে। তিনি কম্যুনিষ্ট মতাদর্শ গ্রহন করেন। এই সময়ে লেখক হিসেবে তিনি বিভিন্ন কর্মকান্ড ও আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবেও কাজ করেন। বাস্তব জীবন থেকে শিক্ষা নেবার জন্যে তিনি খামারে গেছেন, কাঠুরিয়াদের সঙ্গে দিন কাটিয়েছেন, পতিত জমি উদ্ধারকারী দলের সঙ্গে থেকে নির্মাণ ও উৎপাদনের কাজও দেখেছেন। এক সময়ে রাজনৈতিক টানা পোড়েনে তাকে পার্টি থেকে বহিষ্কৃত হতে হয়েছিল।
চীনের জীবনের সাথে তার পরিচয় ছিল গভীর। তাই তার কবিতাতে বারবার শোনা গেছে বিধ্বস্ত অথচ সংগ্রামী চীনের কন্ঠস্বর –
She has arisen
From decades of humiliation,
From the pit dug by her enemy. [ She has arisen ]
তিনি তার সময়কার একজন জনপ্রিয় কবি এবং নিঃসন্দেহে চীনের একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি।
আই ছিং লিখেছেন, ‘কবির সংবেদনশীলতা আর জনসাধারণের সংবেদনশীলতা একাত্ম।’ এই কবি কবিতা লিখেছেন জনগনের অনুভূতিকে ছুঁয়েই। তার কবিতা কোন স্বর্গীয় বা বিলাসী কল্পনা নয়। তার কবিতাতে উঠে এসেছে লোকজীবনের অভিজ্ঞতা, কবিতার কথায় এসেছে লোকজীবনের আঙ্গিক। তার কবিতা সাধারণ জীবনেরই অভিজ্ঞতার ফসল। যেমন,
ঘাসকাটা ছেলে একা কেটে চলে ঘাস
বাঁকানো শরীর তার, মাথা নীচু, শুধু চলে হাত ……
…… রোদ লেগে কাস্তে থেকে চারদিকে ঠিকরে যায় সোনা। [ঘাস কাটা]
‘একটি গ্রামের জন্যে কবিতা’তে কবি বর্ণনা দিয়েছেন যে গ্রামটির, সেখানে ‘প্রাচীন পাইন গাছের মর্মর উঠে আসে হাওয়ায়’, সেখানে বেড়ার উপরে বাড়ে ‘আইভি লতারা’, সেই গ্রামের বাগানটা যেন ‘মৌমাছিদের কারখানা, পিঁপড়েদের গুদাম, ঝিঁঝিঁদের গান শেখার ঘর।’ সেই গ্রামের ঘরগুলো যেন শীতে কাঁপা লোকের মতো পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে আছে। কবির কলমে নিচে উদ্ধৃ্ত কবিতাটাতে উঠে আসে অন্যান্য মানুষদের সাথে চাষীদেরও কথা –
আমার মনে পড়ে গাঁয়ের বহু নিপীড়িত চাষীদের কথা
মুখ তাদের পাইন অরণ্যের মতো কঠিন নিষ্করুণ
চামড়া তাদের পাইন-বাকলের মতো কুঁকড়ে যাওয়া
হতাশা আর মিথ্যা প্রত্যাশায় ক্ষীণ তাদের চোখ। [একটি গ্রামের কবিতা]
একদিকে প্রকৃতির অনাবিল সৌন্দর্য, অন্যদিকে শোষিত মানুষদের দৈন্যপীড়িত জীবনের চিত্র। তার মতো আর কজন কবিই বা আঁকতে পেরেছেন?
চিত্রকল্প বা ইমেজ হলো কবিতার অলঙ্কার। আই ছিং-এর কবিতার বাস্তবধর্মী ইমেজগুলি আমাদের অভিভূত করে।
শীতকালের পুকুর
শুকিয়ে আসা বুড়ো মানুষের চোখের মতো
পরিশ্রমে খসে যাওয়া জ্যোতিহীন আবছা। [শীতের পুকুর]
কিংবা
প্রাচীন অতীতের কবর থেকে …
বালিয়াড়ির ওপর দিয়ে আগুনের চাকার মতো
সূর্য গড়িয়ে আসে আমার দিকে … । [সূর্য]
ভারতবর্ষের কোন কোন লেখক কবিতায় প্রশ্ন তোলেন, - যে বসন্তকালে কোকিল কেশে কেশে রক্ত ওঠায়, সে কেমন বসন্ত? সেই শতাব্দীতেই ভিন্ন একটা দেশের কবি আই ছিং তার কবিতায় তুলে আনেন নীচের ছত্রগুলি –
যেদিন আমরা ছিলাম প্রবঞ্চিত সেদিনও জীবনে বসন্ত এসেছিল
যেদিন আমরা ছিলাম নির্বাসিত সেদিনও জীবনে বসন্ত এসেছিল
যেদিন আমরা ছিলাম কারাগারে সেদিনও এসেছিল বসন্ত
যেদিন কন্ঠরুদ্ধ ছিল নীরব অশ্রুতে সেদিনও এসেছিল বসন্ত [বসন্ত মায়াবিনী]
আই ছিং তার কবিতায় যুগ ও সময় সম্পর্কে সচেতন। তার কবিতায় সমসাময়িক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অনায়াসেই উঠে আসে।
বাষ্পীয় ইঞ্জিন এনেছে শিল্প-বিপ্লব
পারমানবিক পদার্থবিদ্যা জন্ম দিয়েছে আনবিক বোমার
আর আজ, একদিন যেভাবে পায়রা উড়িয়ে দিতাম,
আকাশে পাঠাই উপগ্রহ ……
…… ইলেকট্রনিক কম্পিউটর আমাদের ঠেলে
পৌঁছে দিচ্ছে একবিংশ শতাব্দীতে। [আলোক বন্দনা]
এই কবিতাতেই কবি লেখেন শোষিত জনগন ও শোষিত সময়ের কথা। সমস্ত মানুষের সাথে মিলেমিশে থাকবার সাম্যবাদী ধারণাটাও ব্যক্ত হয় এই কবিতায়।
আলো সমস্ত মানুষের
ভবিষ্যত সমস্ত মানুষের
যা কিছু সম্পদ আছে পৃথিবীর সব মানুষের
আলোর সঙ্গে একসঙ্গে আমরা চলি ….
জনতার সঙ্গে আমরা অপরাজেয়। [আলোক বন্দনা]
আই ছিং তৎকালীন চীনদেশের একজন সংগ্রামী কবি। তিনি এক জায়গাতে লিখেছেন -
‘সত্য প্রকাশ করার অসুবিধে আছে, বিপদের আশঙ্কাও আছে। কিন্তু কবিতা যদি লিখতেই হয়, তবে বিবেক বিসর্জন দিয়ে মিথ্যার সেবা করা চলবে না।’ তারই অনুসারী নীচের লাইনগুলো –
তোমরা আমাকে ভয় পাও
কারণ আমি সত্যের সঙ্গে মিশে আছি
তোমরা আমাকে ঘৃণা কর
কারণ আমি জনতার সঙ্গে মিশে আছি
…………
আমাকে দেখাও মৃত্যুর ভয়
কিন্তু অনেকদিন থেকেই আমি প্রস্তুত [চুপ, কার কন্ঠস্বর]
কবি আই ছিং আজীবন কবিতা লিখেছেন জীবনের জন্যে। ফরাসী কবি লুই আঁরাগ প্রখ্যাত রুশ কবি মায়াকোভস্কি সম্পর্কে লিখেছিলেন, - ‘মায়াকোভস্কি তার স্বদেশ, পার্টি ও মানবজীবনের জন্যে সরাসরি স্বোচ্চারে যে কথগুলো বলে গেছেন, তা উৎসারিত হয়েছে তার শিল্পসঞ্জাত মনের গভীরতা থেকে; তার কথাগুলো তার ভালোবাসারই আন্তরিক উচ্চারণ’। চীন দেশের কবি আই ছিং সম্পর্কেও মূলগতভাবে একই কথা প্রযোজ্য।
তথ্যসূত্র / আই ছিং এর কবিতার উদ্ধৃতি –
(১) আই ছিং এর নির্বাচিত কবিতা । ভাষান্তর – শিশির কুমার দাশ [প্রমা প্রকাশনী, কোলকাতা]
(২) পেঙ্গুইন বুক অফ সোস্যালিস্ট ভার্স - অ্যালান বোল্ড সম্পাদিত।
Tags:
কবিতা আলোচনা