সমরজিৎ সিংহ
প্রিয়জনেষু, পীযূষ
সমরজিৎ সিংহ
আপনি লেখা চেয়েছিলেন । প্রথমবার, দিতে পারিনি । খুব খারাপ লেগেছিল । লেখা দেব, কথা দিয়েও, দিতে না পারার যন্ত্রণা, বলে, বোঝাবার নয় । দ্বিতীয়বার চাইলেন, বইমেলায়, লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়নে ঘুরছিলাম দু'জনে, একসঙ্গে । টুকরো টুকরো কথা, যাকে লোকে আলাপ বলে থাকে, হচ্ছিল আমাদের মধ্যে । দিল্লিবাসী আপনি, দেহলিজ নামে এক ম্যাগাজিন সম্পাদনা করছেন বহুদিন ধরে এবং দিল্লির বুকে বাংলা ভাষাকে টিকিয়ে রাখার এক অদম্য প্রয়াসমগ্ন । এটুকুই জানি আপনার বিষয়ে ।
৫০ বছর পূর্ণ হতে চলেছে আপনার আর আমার লেখালেখির অর্ধশতক পেরিয়ে গেছি আমি । এটা এক যোগসূত্র হতে পারে, আবার নাও হতে পারে । এটুকু উপলব্ধি করেছি এত বছর লেখালেখি করে, যে, লেখা আসলে এক মৃত্যু পরোয়ানা, যা থেকে নিষ্কৃতি পেতে লিখে চলেছি আপনি এবং আমি । অথচ নিষ্কৃতি কোথাও নেই । অমোঘ এই সত্যকে কীভাবে লেখায় ধরে একজন লেখক বা কবি, তা নিয়ে ভাববার আছে । আর, এখানেই একজন থেকে আর একজন আলাদা হয়ে যান । ভাষায়, বোধে, কল্পনার জগতে, বাস্তবতার প্রয়োগে, যতিচিহ্ন ব্যবহার থেকে শুরু করে শব্দ প্রয়োগ এবং রসাস্বাদনে ।
জীবনানন্দ থেকে সুধীন্দ্রনাথের দিকে তাকালে এটা উপলব্ধি করা যায় বেশি ।
বলেছি, লেখা এক মৃত্যু পরোয়ানা । এই মৃত্যু পরোয়ানা লেখা কেন, জীবনের সর্বত্র । এবং প্রতিমুহূর্তে । এই পরোয়ানা সম্পর্কে অজ্ঞাত অধিকাংশজন । তাদের আলোকিত করা এক পরম দায়িত্ব, বলে, ভেবেছেন কেউ কেউ । এই 'আলোকিত করা' কথাটিতে প্রবল আপত্তি রয়েছে আমার । আলোকিত শব্দটি শুনলেই গির্জার পাদরিদের কথা মনে পড়ে । কবি বা লেখক পাদরি নন, প্রিচার নন । তার কাজ তো বোধ ও মননের । যে দুই কবির নাম উল্লেখ করেছি, তাঁদের কবিতা তার সাক্ষীও বটে ।
কখনও কখনও ভাবি, লেখা কোনও কাজের নয় । অন্নহীনের মুখে অন্ন যোগাতে পারে না, যুদ্ধ থামাতে পারে না লেখা, সাম্প্রদায়িকতা রুখতে পারে না, ঘৃণার আবহকে পালটে দিয়ে নতুন স্বর্গ রচনা করতে পারে না ! এত না-পারা নিয়ে এতদিন মানব সমাজে টিকে রইল কীভাবে ?
এটা যত ভাবি, লেখক-কবিদের প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে যায় । যেমন শ্রদ্ধা বেড়েছে আপনার প্রতিও । শুধু লেখা নয়, একটি ম্যাগাজিনও করছেন এতদিন ধরে । এটা না করে অন্যকিছু করলেন না কেন ? কখনও ভেবেছেন ? একা, একা, ঘুম থেকে উঠে গিয়ে, নির্জন রাতে, আকাশের দিকে তাকিয়ে ? অনুভব করেছেন কি এই মহাজগতের গোপন রহস্য ? আপনার লেখাও সেই রহস্যের এক অংশ ।
আমরা, সকলেই, রহস্যতাড়িত । এমনকি যে ঈশ্বর বা আল্লাহ বলে মানুষ মত্ত হয়ে থাকে, সেই ঈশ্বর বা আল্লাহও রহস্যতাড়িত । এক অস্তিত্বহীনের সত্তা নিয়ে এত এত বছর মানুষ কল্পনা ও বিশ্বাস করে এসেছে এবং আসছে, আসতে থাকবে, সেটা কি রহস্য নয় ? কবিতা রচনার মত ?
মহাবিশ্ব এক গণিত মাত্র । কেউ কেউ এটাও বলেন । গণিতবিদ, পদার্থবিজ্ঞানের গবেষক, সকলেই, সেই গণিতের সন্ধানে দিনের পর দিন মেতে রয়েছেন, বিশ্বাসে নয়, যুক্তি দিয়ে, যুক্তি খুঁজতে খুঁজতে, কারণ সন্ধানে । আপনার কি মনে হয়নি এসবই তো কবিতা, বিনয় মজুমদার যা ধরতে চেয়েছেন তাঁর লেখায় ?
দেহলিজ-এর জন্য কবিতা পাঠাব, তার আগে, এত কথা কেন বললাম, জানি না ! এটা হয়তো আপনার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে, আপনাকে ভালোবাসা জানাবার সামান্য এক প্রয়াস । কবিতাটি, এই লেখাটির সঙ্গে, আলাদা হয়ে নয়, লেখাটির ভেতরে এক অংশ হয়ে রইল ।
ঈশ্বর ও ফাতেমা বিবি//
দু'পেগের পর, ঈশ্বরকে দেখলাম
গ্লাস উল্টে রাখলেন । তার মানে, তিনি
এবার প্রস্তুত ।
প্রস্তুত বললে, মনে পড়ে যায়, তার বিছানার
কথা । সেখানে রুক্মিণী অপেক্ষারতা কি ?
না কি তিনি, চুপি চুপি, যেতে চাইছেন
ফাতেমার কাছে ?
কাম ঈশ্বরের খেলা মাত্র ।
রুক্মিণীর সাথে খেলেছেন । ইদানিং,
ফাতেমার সঙ্গে গঙ্গাজল অবধি খেলতে চান ।
ফাতেমা বিধবা । সমাজের
দু-চোখ বাঁচিয়ে, এক আধবার, ঈশ্বরের সঙ্গে
খেলেছে হাডুডু । এটুকুই । আর, বুঝেছে, পুরুষ
খেলা ছাড়া কিছুই বোঝে না ।
জানা ও না-জানা নিয়ে, গ্লাস উল্টে রেখে,তিনি আজ
চললেন, ফাতেমা বিবির কাছে নয়,
রুক্মিণীর কাছে নয়, সোজা, আত্মকবরের দিকে ।
তিনি জানেন, পুরুষ নেশা করে, নিজের কবর
নিজ হাতে, রোজ, সাফাই করার জন্য ।
Tags:
ক্রোড়পত্র