উমাপদ কর
রবীন্দ্রগানে কথা এবং ভাব
উমাপদ কর
প্রয়াস
রবীন্দ্রনাথের অধিকাংশ গানে পূজা, প্রেম, প্রকৃতি একাকার হয়ে আশ্রয় খোঁজে। তেমন মাপক নেই, যাতে কোনোটা থেকে আর-একটাকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা যায়। অনুভবকে গুরুত্ব দিলে, নামে ভাগ করার বিষয়টি জটিল থেকে জটিলতর হয়। তবু আমরা ভাগ করে থাকি। ভাগ করায় অনেকসময়ই মনোযোগ দিয়ে বসি। যদিও সংগীতের তাতে তেমন কিছু যায় আসে না। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করলে, তাঁর তিনটে সার কথার মান্যতা দিতে আমার কোনো অসুবিধা হয় না। বরং একটা স্বস্তি মেলে একাত্ম হতে পারায়। যেমন, ১)“গানের কবিতা, সাধারণ কবিতার সঙ্গে কেহ যেন এক তুলাদণ্ডে ওজন না করেন”। ২)“গানের কবিতা পড়া যায় না, গানের কবিতা শুনা যায়”। ৩) “এখন যেমন সংগীত শুনিলেই সকলে বলেন ‘বাঃ ইহার সুর কী মধুর’, এমন দিন কি আসিবে না যেদিন সকলে বলিবেন, ‘বাঃ কী সুন্দর ভাব!’”। এখানে স্পষ্ট হয় তাঁর সংগীতভাবনাটি, যেখানে ভাবকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে সর্বাংশে। গানেও কবিতা থাকে, যাকে আমরা গীতিকবিতা বলি। কিন্তু নিক্তিতে মাপা সম্ভব হয় না, কোথায় গীতিটা বেশি, কবিতা কম, বা ঠিক তার বিপরীত! আমরা সে চেষ্টায় যাব না। পাঠ, অর্থাৎ চোখে পড়া, আর কানে শোনার মধ্যে একটা স্পষ্ট পার্থক্য আছে। আর সেটা শুধু ইন্দ্রিয়র নয়, একই ইন্দ্রিয়ের গুণের পার্থক্যও। এক ইন্দ্রিয় যেখানে মানসপটে ছবি আঁকতে ওস্তাদ, আরেক ইন্দ্রিয় সেখানে ছবি নয় ধ্বনির কারবারি, মস্তিষ্কে ধ্বনির নানারকম সিগন্যাল পাঠায়, যেখানে জড়িয়ে থাকে শ্রুতিমধুরতা বা বিশৃঙ্খলা্র প্রশ্নটি। সংগীতে ধ্বনিগুণের প্রাধান্য বেশি, ছবি উঠে আসার চেয়ে। এই ধ্বনিগুণের মধ্যে সুর-তাল-লয় পড়ে। কিন্তু শুধু তার বিশুদ্ধতা ও মোহিনীশক্তিই সংগীতের আরাধ্য হতে পারে না, যতক্ষণ না একটা ভাবের সুষম প্রকাশ ঘটে। এমন প্রেক্ষাপটে রবীন্দ্রগানের কথায় ভাব-প্রকাশক ভাবনা এবং ব্যক্তি-আমার সঙ্গে যোগসুত্রতা ও অনুভবের আলোচনাই হবে আমার প্রয়াস। সংগীত বিষয়ে হয়তো-বা কেউ কোনোদিন আলোকপাত করবেন এর অপূর্ণতা পূরণ করতে।
এখানে আমি ৩-টি পূজা পর্যায়ের গান নিয়ে কথা বলব।
১) আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।
তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।।
তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা,
বসন্ত নিকুঞ্জে আসে বিচিত্র রাগে।।
তরঙ্গ মিলায়ে যায় তরঙ্গ উঠে,
কুসুম ঝরিয়া পড়ে কুসুম ফুটে।
নাহি ক্ষয়, নাহি শেষ, নাহি নাহি দৈন্যলেশ—
সেই পূর্ণতার পায়ে মন স্থান মাগে।।
ওপরের গান-কথায়, একটা নিত্যতার ভাবনা উঠে এসেছে— জীবনযাপনে দুঃখ আছে, মৃত্যু আছে বিরহ ও জ্বালাযন্ত্রণাকে সঙ্গী করে। সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত যেমন মহাজাগতিক নিত্যতা, তেমনি জাগতিক ক্ষেত্রে জন্ম ও মৃত্যু। জন্ম-র পরিণতি মৃত্যুই। কিন্তু মৃত্যু মানেই ক্ষয় নয়, নয় অন্তিম কোনো এক ঘটনা। কারণ, নিত্যজন্মও ঘটনা, যা মৃত্যুর পরিপূরক। সূর্যাস্ত যেমন আগামী সূর্যোদয়ের প্রতিশ্রুতি, তেমনি মৃত্যুর মধ্যেই সঞ্জীবিত নয়া প্রাণসঞ্চার। অর্থাৎ একটা প্রবাহ, আদি-অন্তহীন। আমরা সেই প্রবাহের মধ্যে মৃত্যুকে ধারণ করেও নিরন্তর বহমান।
প্রবাহের ভাবনাটিকে স্পষ্ট ও চিহ্নিত করতে নৈসর্গিক দিকগুলো উপাদান ও অনুষঙ্গ হিসেবে এসেছে। এ-সবই জীবনের নিত্যতার সঙ্গে যুক্ত। যেমন, সমুদ্রে একটা ঢেউ তীরে এসে মিলিয়ে গেলেও, আরেকটা ঢেউ নেচে এসে পাড়ে মিলাতে চায়, এবং নিরন্তর। ফুলেরকুঁড়ি থেকে পাপড়ি ঝরে পড়ার জার্নিটাও তাই, একটা বহমানতা। ফলে, দুঃখ-বিষাদ-দহন ইত্যাদির মধ্যেই আনন্দ-মহানন্দ-শান্তির বাতাবরণ, আর অনন্তের প্রকাশ। ‘অনন্ত’ শব্দটি প্রবাহের দ্যোতক, যার শেষ নেই। আধ্যাত্মিকতার প্রশ্নে এই গান-কথায় ‘পূর্ণতার পায়ে স্থান’ শব্দবন্ধটি এসেছে। আমরা জানি, তিনি ব্রাহ্মবাদী, নিরাকার ইশ্বর-বিশ্বাসী। অপূর্ণের পূর্ণতায় বিলীন হওয়া। এখানেই জেগে ওঠে আনন্দ, মহানন্দ। মৃত্যুতেও আনন্দানুভব উপনিষদক ভাব-ভাবনাকে প্রলম্বিত করে। ঠিক যেন বৌদ্ধদের বদ্ধতা থেকে মোক্ষে মুক্তি, সনাতন ধর্মে আত্মার পরমাত্মায় মিলিত হওয়া, বা বাকি সব ধর্মের ব্যক্তি-মুক্তির কথা। এই গান-কথা তাঁর ব্যক্তিজীবনজাত মৃত্যুজনিত কষ্টানুভবের অভিঘাতে রচিত। কিন্তু উপস্থাপনার গুণে সর্বজনের হয়ে ওঠে। ব্যষ্টি সমিষ্টিতে ঠাঁই করে নিয়ে সার্থকতা খুঁজে পায়। এখানে নিজের প্রসঙ্গক্রম উঠে আসে। ১৯৮০ সালের ৩ আগস্ট খুব ভোরে হাসপাতালে বাবা প্রয়াত হন। সারারাত জেগে থাকার পর এই মৃত্যু ২৫ বছরের আমাকে যখন দিশেহারা করে তুলেছিল, আমি এক বন্ধুকে নিয়ে হাসপাতালের পাশেই ভাগিরথী নদীর একদম জলঘেঁষা পাড় ধরে হাঁটতে থাকি। খুব কথা বলছিলাম, খুব কথা, বাচালের মতো। আমরা হাঁটছিলাম স্রোতের বিপরীতে। হাওয়া ছিল আমাদের অনুকূলে, ফলে ছোটো ঢেউ উঠে ভেঙে ভেঙে পড়ছিল। তখন কি ছাই এত নিঁখুত দ্যাখা সম্ভব ছিল? ছিল না। চোখ চলে যাচ্ছিল, এই যা। একসময়, যখন অনেকটা চোখের জল প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, ফিরতে-ফিরতে ভেতর থেকে কে যেন গেয়ে উঠল— ‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে’। ইত্যাদি। উচ্চারণ ছিল না। গুঞ্জরণও না। শুধু ‘তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে’। জায়গাটায় এসে আবার চোখভরা জলের সঙ্গে দমবন্ধকরা ভাবটা যেন কেটে গিয়েছিল। এই গানের কথা লিখতে গিয়ে চল্লিশ বছর আগের জীবনস্মৃতি উঠে এল। সেখানেও চোখের জলে আনন্দ আঁকা। সেই থেকে আজও প্রতিটি মৃত্যুর পরেই যে গানটি আমার মনে আসে, তা এই গান। এমনই প্রভাব এই গানের। জীবন-প্রবাহই এই গানকথার মূল ভাব, যা প্রকৃতির স্বাভাবিক নির্বাচন, আর যেখানে আধ্যাত্মিকতা এসেছে পায়ে-পায়ে। প্রকৃতি আর পূজা মিলেমিশে একাকার।
২) ধায় যেন মোর সকল ভালোবাসা
প্রভু, তোমার পানে, তোমার পানে, তোমার পানে।
ধায় যেন মোর সকল গভীর আশা
প্রভু, তোমার কানে, তোমার কানে, তোমার কানে।।
চিত্ত মম যখন যেথা থাকে সাড়া যেন দেয় সে তব ডাকে,
যত বাঁধন সব টুটে গো যেন
প্রভু, তোমার টানে, তোমার টানে, তোমার টানে।।
বাহিরের এই ভিক্ষা-ভরা থালি এবার যেন নিঃশেষ হয় খালি,
অন্তর মোর গোপনে যায় ভরে
প্রভু, তোমার দানে, তোমার দানে, তোমার দানে।
হে বন্ধু মোর, হে অন্তরতর, এ জীবনে যা-কিছু সুন্দর
সকলই আজ বেজে উঠুক সুরে
প্রভু, তোমার গানে, তোমার গানে, তোমার গানে।।
এই গানের সুরটাই চিরকাল আমায় টেনে নিয়ে চলেছে। সুরের তেমন কিছু বুঝি না; কিন্তু শ্রুতিমধুরতার স্বাদ নিতে শিখেছে মস্তিষ্ক ভায়া দুটো কান। শ্রবণের একটা মধুরিমা থাকে, যা তৈরি করে বিভিন্ন সুরের মূর্ছনা। স্বর আর সুর মিলে যখন ভাবটিকে মরমে প্রবেশ করায়, তখন তার আবেশেই বিভোর হয়ে পড়তে হয়। ঠিক এতটুকুই বলতে পারব। বাকিটা বিবৃত করার ভাষা নেই।
তাই বলে আমি গানের কথাগুলোকে দূরে সরিয়ে রাখতে রাজি নই। ওই প্রভু-টুকু বাদ দিয়ে যৌবনে তো এই গানকে প্রেমের গান হিসেবে ভাবতেই অভ্যস্ত ছিলাম। যেন প্রেমিকার উদ্দেশ্যেই গুনগুনিয়ে উঠতাম— ‘ধায় যেন মোর সকল ভালোবাসা’, প্রি্য়, ‘তোমার পানে, তোমার পানে, তোমার পানে’। সবসময় সামনাসামনিই নয়, একাকীত্বের মধ্যেও যখন তখন মন, ভোলামন হয়ে গাইতে চাইত— ‘হে বন্ধু মোর, হে অন্তরতর, এ জীবনে যা-কিছু সুন্দর/ সকলই আজ বেজে উঠুক সুরে’, প্রিয়, ‘তোমার গানে, তোমার গানে, তোমার গানে’। প্রেমিকা শুনল কী শুনল-না, সেটা বড়ো কথা হয়ে উঠত না। বড়ো হয়ে থাকত নিজস্ব নিবেদন আর আর্তিটুকু, বড়ো হয়ে দাঁড়াত খঞ্জ-সুরের পাহাড় ডিঙোনোর প্রয়াস। মনে মনে কিন্তু খুব ভালো লাগত, কোথাও যেন একটা সমর্পণের আরাম, একটা নিরাময়জনিত শান্তি। একটা ফাঁকাভাবও কিন্তু একইসঙ্গে কোথা থেকে জেগে উঠত, আজও হয়তো ওঠে, কারণটা যার আজও অজানা। তখনই চোরকাঁটার মতো একটা প্রশ্ন জেগেই ওঠে— সমস্ত ভালোবাসাকে কি তোমার প্রতি ধাইয়ে ছুটিয়ে নিতে পারিনি? আমার সমস্ত আশা-ভরসার স্থল হিসেবে কি তোমাকে দেখতে পারিনি? কোথাও কি ফাঁক রয়ে গেছে, নয়তো এই ফাঁকা-বোধই বা কেন? সবার এমনসব হয় কিনা জানি না। আমার হয়।
আর রবীন্দ্রনাথের কী মনে হতো গাইতে গাইতে? বলা সম্ভব নয়। অনুমান করা যেতে পারে যা অন্তত দুটো সম্ভাবনার দরজা খুলেই রাখে। প্রথম সম্ভাবনাটা অবশ্যই তাঁর অন্তরতর প্রভুর উদ্দেশ্যে। লেখা রয়েছে যে! কী করে অস্বীকার করা যায়? সেই সর্বময়ের প্রতি তাঁর প্রার্থনাটা সহজ কিন্তু পালনে কঠিন। আর কঠিন বলেই প্রার্থনা— সমস্ত ভালোবাসা উজাড় করে দিতে চান তিনি একাত্ম হয়ে। চান, তাঁর সব আশা যেন শুধু প্রভুর কানেই গুঞ্জরিত হয়। মন যেদিকে যত খুশি বিক্ষিপ্ত থাক আর বাঁধা থাক, প্রভুর ডাকের টানে যেন সেই মন নিমেষে একগামী হয়ে ধেয়ে যায় সাড়া দিয়ে। প্রভুর দান প্রিয়তম ও মহাদান। সেই দানে হৃদয়ের গোপন পূর্ন হয়ে যাক। বাহ্যিক ভিক্ষালব্ধ পাত্র খালি হয়ে যাক, নয়তো অন্তরের গোপন মহাদানে পূর্ণ হওয়া অসম্ভব। আর চান জীবনের যা কিছু সুন্দর তা প্রভুর গানে সুরে বেজে উঠুক। তাহলেই ধন্য জীবন। বোঝা যাচ্ছে গান-কথায় প্রভুর (যিনি আবার বন্ধু এবং অন্তরতর) মধ্যে নিজেকে সম্পূর্ণ সমর্পণের ইচ্ছায় সমস্ত প্রার্থনা তাঁর। সেটাই গানের মূল ভাব-ভাবনা। এই প্রার্থনাই তাঁর পূজা। আরেকটি সম্ভাবনার কথা আগেই বলেছি, আমার ভাবনা দিয়ে, সে ভাবনাকে আমল দিতে গিয়ে গীতিকার হয়তো একটু হাসবেন, কিন্তু প্রাণে ধরে সবটা ফেলে দিতে পারবেন না। পারবেন না এই অর্থে একটা সময় আসে, যখন প্রেমিকার মধ্যেও প্রভুরই অস্তিত্ব দেখে মানুষ। আর রবীন্দ্রনাথ যে মানসিক অবস্থানে তেমন একটা চূড়ান্ত জায়গায় পৌঁছেছিলেন, তা আমাদের জানা। যিনি সর্বভূতে সেই মহাত্মনের উপস্থিতি উপলব্ধি করতে পারেন, তাঁর প্রিয়া আর প্রভু এক তারে বাঁধা পড়ে যায়।
‘তোমার পানে’, ‘তোমার কানে’ ‘তোমার টানে’, ‘তোমার গানে’, এমন চারটে মিল সমৃদ্ধ জায়গা আছে গান-কথায়, এবং প্রত্যেকটি তিনবার করে গীত হয়। সুরটাও খেলে খেলে আকূল করা। একেকটি প্রার্থনা বা নিবেদনের পরে এই আকূলতার রেশ থেকে যায়। ভালোবাসা ‘তোমার পানে’, আশা ‘তোমার কানে’, বাধামুক্ত ছুটে যাওয়া ‘তোমার টানে’, আর সুন্দরের সুর বেজে ওঠা ‘তোমার গানে’। চারটে ক্ষেত্রেই এক বিশেষ সংবেদন কবি-গীতিকারকে যেন নিঃস্ব করে ছাড়ে। আর আমাদের! আমরাও ভালোবাসায় নিঃস্ব হতেই চাই; কিন্তু শত আবিলতা তা হতে দেয় না। ভালোবাসা এক প্রহেলিকা হয়েই আমাদের মধ্যে স্থিত, যার আকূতি অপরিসীম; কিন্তু যা সর্বস্ব নিবেদনের জন্য সেভাবে প্রস্তুত নয়। এ-ও হৃদয়ের ক্ষরণ। ভালোবাসা, আশা, ভিক্ষাভরা থালি, যা-কিছু সুন্দর সব নিয়ে যেন ‘হে বন্ধু মোর’ তোমাতে লীন হতে পারি।
৩) মহারাজ, একি সাজে এলে হৃদয়পুরমাঝে!
চরণতলে কোটি শশী সূর্য মরে লাজে।।
গর্ব সব টুটিয়া মুর্ছি পড়ে লুটিয়া,
সকল মম দেহ মন বীণাসম বাজে।।
একি পুলকবেদনা বহিছে মধুবায়ে!
কাননে যত পুষ্প ছিল মিলিল তব পায়ে।
পলক নাহি নয়নে, হেরি না কিছু ভুবনে—
নিরখি শুধু অন্তরে সুন্দর বিরাজে।।
রবীন্দ্রনাথের জীবনদেবতা নানা নামে উচ্চারিত, ধ্বনিত। কখনো বন্ধু হিসেবে ‘বন্ধু’, ‘সখা’, ‘পরানসখা’; কখনো নিরাকার ঈশ্বর হিসেবে, ‘প্রভু’, ‘ভুবনেশ্বর’, ‘প্রাণেশ’; কখনো জীবনস্বামী হিসেবে, ‘জীবনস্বামী’, ‘নাথ’, ‘হৃদয়হরণ’, ‘প্রাণের মানুষ’; কখনো প্রেমিক হিসেবে, ‘ভালোবাসার ধন’, এবং অবশ্যই কয়েকটি সর্বনাম, যেমন, ‘তুমি’, ‘তোমার’, স্বল্প হলেও ‘তিনি’ বা ‘সে’। এখানে সেই প্রেমিক বা হৃদয়অধিরাজ ‘মহারাজ’ হিসেবে চিহ্নিত, এবং এমনই ঐশর্যময় তিনি, এমনই সাজসজ্জা তাঁর, যে কোটি-শশী ও সূর্যও লজ্জায় মরে। আজ এমন এক রূপপ্রভায় মহারাজ গীতিকারের ‘হৃদয়পুরমাঝে’ এসে ঠাঁই নিয়েছেন। এক পরম তেজপ্রভ শক্তিমান বা স্নিগ্ধউজ্জ্বল প্রভার অস্তিত্ব আজ তাঁর ভেতরে। তাঁর উপস্থিতি অনেক প্রভাব ফেলে জীবনে। ব্যক্তিগর্ব ধুলোয় মেশে, আর দেহ-মন বেজে ওঠে বীনার ঝঙ্কারে। আশ্চর্য এক আনন্দজ বেদনা মধুময়বাতাসে বয়ে যায়। বাগানের সব ফুল যেন ‘মহারাজ’-এর পায়ে এসে শোভা পায়। পলকহীন নয়নে শুধু সেই সুন্দরকেই দেখে যান, অন্তরে অনুভব করেন, জগতের আর কিছুই যেন নজরে আসে না। এক এবং একমাত্র ‘সুন্দর’-এর অস্তিত্ব বিরাজ করতে থাকে অন্তরে। গানের কথাগুলিকে সামান্য বিশ্লষণে এমনই এক মনোজাগতিক অবস্থানে পৌঁছাই আমরা।
গানকথার কয়েকটি ক্ষেত্র এবং কিছু শব্দ ও শব্দজোড়ের ওপর ধ্যান দিলে অভিব্যক্তির অভিঘাত আরও বৃদ্ধি পায়। প্রথম দুটি পঙ্ক্তি-তে ব্যতিরেক অলংকারের প্রয়োগ ‘মহারাজ’-কে আরও উজ্জ্বল ও উৎকর্ষিত করেছে। সুতরাং বলা চলে হৃদয়পুরমাঝে আজ যার অবস্থান, তার তেজ-তাপ ও অন্যান্য গূণাবলি সূর্যের চেয়ে প্রবল। পঞ্চম পঙ্ক্তিতে একটি শব্দজোড় ব্যবহৃত হয়েছে ‘পুলকবেদনা’। একদম পরস্পর বিরোধী দুটি শব্দের সহাবস্থান। ‘মহারাজ’-এর মতো এক শক্তিমানের হৃদয়ে অবস্থান মহানন্দের কথা। পুলক তাই। আবার মহানন্দে মানুষ কেঁদেও ওঠে, সেটা বেদনা। সর্বোপরি আনন্দে বেদনঘন মন। বলা যায় আনন্দ থেকে জন্ম নেওয়া বেদনা। এই ‘পুলকবেদনা’ শুধু অন্তরকেই নয়, যেন ‘মধুবায়ে’ বয়ে গোটা পরিমণ্ডলটিকেই বদলে দিয়েছে। শেষ পঙ্ক্তিটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এই পঙ্ক্তিতে ‘মহারাজ’ আর সুন্দর সমার্থক। হৃদয়পুরমাঝে এসে যে মহারজ-এর অবস্থান, সেই মহারাজ প্রকৃতপক্ষে ‘সুন্দর’ হয়ে হৃদয়ে বিরাজমান। আমরা একটা উপলব্ধিতে পৌঁছাতে পারি, রবীন্দ্রভাবনায় বা চেতনায় পরমেশ্বর সুন্দরের প্রতীক।
এখানে ‘মহারাজা’-র জন্য প্রেমও অসাধারণ পর্যায়ে। তাঁর অস্তিত্ব অন্তরে অনুভূত হলে বাহ্যিক জগৎ যেন অসাড় হয়ে যায়। গর্ব টুটে, দেহ-মনে বীনা বাজে, চোখে পলক পড়ে না, চোখে ধরা দেয় না আর কিছু। শুধু প্রেমিক হৃদয়ে সুন্দরের উপস্থিতি। প্রেমাস্পদ আর মহারাজ একাকার হয়ে যান আনন্দে।