প্রাণজি বসাক
সহজ কথায় পীযূষ প্রাণবন্ত উচ্ছ্বাসবন্ত কারিগর
প্রাণজি বসাক
“গন্ডিটা সম্পূর্ণ করো,
নইলে
ক্ষেত্রফল অভিসারে যাবে
তখন ঘর বড়ো একা হয়ে যাবে হে…. “ ( কুয়ো/ আকাশচুম্বন)
শ্রদ্ধেয় কর্মঠ মানুষ গোপাল চন্দ্র পাল। দীপক প্রকাশনী। বলা হয় দিল্লির একমাত্র বাংলা বইয়ের প্রকাশনী সংস্থা। নতুন দিল্লি কালীবাড়ি প্রাঙ্গনে আয়োজিত বইমেলায় নিজস্ব স্টল নিয়ে বসেছেন। শুধু তাই নয় বিশেষ অনুমতি সাপেক্ষে তাঁর স্টলে সন্ধ্যাবেলায় একটি কবিতা পাঠের আয়োজন করা হয়েছে।আমি যাব।তখন কলকাতার বিশিষ্ট কবি ঈশিতা ভাদুড়ী দিল্লিতে পোস্টিং।ওকে আমি আমন্ত্রণ জানালাম এবং সঙ্গে করে হাজির হলাম। বইমেলা ঘোরাঘুরি করে গোপালদার স্টলে হাজির হলাম আমরা।দেখি অনেকেই হাজির। একটি পাঞ্জাবী পরা যুবক দেখলাম বেশ তৎপর। হাতে একটা ট্যাব নিয়ে এদিক ওদিক করছে। কবি জয়শ্রী রায় আমাকে ডেকে পরিচয় করিয়ে দিল – পীযুষ বিশ্বাস ,কবি। বেশ লেখালেখি করে।তারপর আমাদের সবার সঙ্গে পরিচয় এবং ছবি তোলা হলো।এই শুরু… তারপর।
দিল্লি হাটার্স নিয়ে লিখতে বসলে একটা আস্ত উপন্যাস হয়ে যাবে।বারো বছর বয়স হয়ে গেছে। এগারো জনের কবিতা নিয়ে আমার সম্পাদনায় “ দিল্লি হাটার্স কবিতা সংকলন” বেরিয়ে গেছে। গোটা আটেক নিয়মিত সংখ্যা হয়েছে। লোকজন আসা যাওয়া চলছে। নামও বেশ ছড়িয়ে পড়েছে। এক বিশেষ পরিস্থিতির কবলে পড়ে আমি একদিন আত্মার দিল্লি হাটার্স থেকে নিঃশব্দে অনুযোগহীন সরে এলাম। তারপর থেকে কোনদিন দিল্লি হাটে যাইনি। কবি জয়শ্রী রায় ইতিমধ্যেই দিল্লি হাটার্স আড্ডায় যাতায়াত শুরু করেছে এবং ও একদিন পীযূষকে নিয়ে যায় সেখানে। তারপর দীপংকরের সাথে খুব বন্ধুত্ব হয়। এমনকি দীপংকরের “ শূন্যকাল” অনলাইন কাগজের টেকনিক্যাল দিক পীযূষ সামলাতে থাকে।
আমি আইআইটি ক্যাম্পাসে,পীযূষ মহাবীর এনক্লেভ বেঙ্গলী কলোনিতে।মাঝে বেশ দূরত্ব। তবুও কবিতার খাতিরে দেখা সাক্ষাৎ চলতে থাকে। দিল্লিতে বিশেষ অতিথি বারীন ঘোষাল। পীযূষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে আয়োজন করে ফেলল সারাদিনের আড্ডা মধ্যাহ্ন ভোজসহ।বারীনদা মধ্যমনি। দিল্লি হাটার্সএর সভাপতি প্রো.মিহির রায়চৌধুরী। উনিও রিটায়ারমেন্ট করে মহাবীর এনক্লেভে থিতু হয়েছে। অসুস্থতা থাকা সত্বেও বৌদিসহ এলেন। এলেন দেবুদা ,দেবব্রত সরকার। কিছু খাবার বানিয়ে নিয়ে এসেছে ভাস্বতী গোস্বামী। এই আড্ডা মিথ হয়ে আছে। পীযূষ একটি বড় ফ্ল্যাট কিনে উঠে এলো কাছাকাছি। আমিও আইআইটি ক্যাম্পাস ছেড়ে উঠে এলাম পাশেই বিন্দাপুর ডিডিএ ফ্ল্যাটে।
দুজনের মাঝে একটা জায়গা পেলাম বড়ো মাপের নিমগাছ তলায়।আমরা দুজনেই মাঝে মাঝে বসা শুরু করি নিমছায়া আড্ডায়। কবিতা পড়া হয়। আশা হতাশা সব মিলিয়ে চলতে থাকে। দুপুরের তপ্ত হাওয়া আমাদের কাহিল করে দিলে উঠে বাড়ি ফিরে যাই। আবার আমার বাড়ির একটা লোভনীয় ছাদ ছিল। খুব আশা ছিল ,এই ছাদই হবে দিল্লির বাংলা কবিতার পীঠস্থান। পীযূষ কয়েকবার এসেছে। কিন্তু আর কেউ এলো না। আমিও আইআইটি জম্মুর দায়িত্ব সামলাচ্ছি। যেন সময় অস্থির। বউয়ের ভালো লাগছে না এ বাড়ি ,তিনতলা ওঠানামা ঝামেলা। পীযূষের পাড়ায় ভাড়া ঘরে উঠে এলাম। ভাগ্যের পরিহাস।সাহিত্য জমে উঠল। কিন্তু তার আগেই ঘটে গেছে এক বিশাল অপ্রিয় ঘটনা।
দীপংকর দত্ত-র অকাল মৃত্যু। জানুয়ারি ২০১৭। কেউ নেই। পীযূষ আয়োজন করল স্থানীয় কালীবাড়িতে শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান। আমি মুখাগ্নি করেছি বলে আমাকেই শ্রাদ্ধকর্মে বসতে হলো। একজন কবির পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন হলো কবিদের ভালোবাসায় শ্রদ্ধায়। অনেকেই এসেছিলেন সেদিন। পীযূষের বউ বিউটি বিশ্বাস যথাসাধ্য আতিথেয়তা দিয়েছে। এরপর পীযূষ ধরল দীপংকরের ছেড়ে যাওয়া অনলাইন কাগজ “ শূন্যকাল” সম্পাদনা, নিজেই সম্পাদক হয়ে। পীযূষ একটা শক্ত ভিতের উপর দাঁড়িয়ে পড়েছে। ওর নিষ্ঠায় অবাক হয়ে পড়ি।দীপংকর নেই বলে যে শূন্যতা আমার মধ্যে বিরাজ করছিল তা খানিকটা হলেও ভরাট হতে থাকে। আমাদের মধ্যে একটা দীপ জ্বলতে থাকে যা দীপংকর জ্বালিয়ে রেখেছে।
আকাশচুম্বন।পীযূষকান্তি বিশ্বাস। অভিযান পাবলিকেশন,কলকাতা।প্রথম প্রকাশ - জানুয়ারি ২০১৬। দাম - ১০০ টাকা। ওর দ্বিতীয় কবিতার বই।প্রথম কবিতার বই - ঘুমঘর।সেবছর দিল্লির বাংলা বইমেলায় ও আলাদা একটা স্পেস মেনেজ করে সস্ত্রীক নেমে পড়ে। ফলাফল পাওয়া গেল, বেস্ট সেলার তকমা সেটে সামাজিক মাধ্যমে খবর চাওড় হয়। স্বস্তি পেলাম,যাক কবিতার বই বিক্রয় হচ্ছে। এটা আমাদের কাছে আশার কথা। ভালো প্রয়াস। এইতো সেদিন এই বই থেকে তন্দুরি কবিতাটি আমি পাঠ করলাম এক অনুষ্ঠানে।নতুন স্বাদ আছে কবিতাগুলোয়।পীযূষ আবদার করে যে ও দিল্লি থেকেই সাহিত্য জীবন বা কবিতা চর্চা শুরু করে। কোনও এক অজানা কারণে তারপর আর কোনো কবিতার বই বের করেনি। তাগাদা লাগাই। কিন্তু একটা কাজ ও করে যাচ্ছে ,সেটা ওর কৃতিত্ব।
দেহলিজ। অনলাইন কাগজ হলেও প্রিন্ট সংখ্যাও বের করে প্রয়োজন অনুসারে। শুধু বাংলা নয় ইংরেজি ও হিন্দি লেখা থাকে।একটু পিআর সামলে চলে এই রুখাশুখা দিল্লির চৌহদ্দিতে। বেশ কয়েকটি সংখ্যা এর মধ্যে নামিয়ে দিয়েছে। করোনা কালে আমি একটি ১০৯৬ লাইনের কবিতা লিখি “ তারপর তাহার পর “ , এটা বের করে দেহলিজ এ।পরে বই হিসেবে বের হয়। আমরা বাংলাদেশ যাই। ফিরে এসে দেহলিজ বাংলাদেশ সংখ্যা বের করা হয় ,,সম্পাদনার ভার পরে আমার উপর। বেশ কষ্টসাধ্য কাজ।
আরজি কর ঘটনা নিয়ে মেতে উঠল। লেখা জোগাড় করে নামাল একটি সংখ্যা। পরে প্রিন্ট সংখ্যাও করেছে। এসব পীযূষের নিজস্ব প্যাশন।চাকরি সংসার সবকিছু সামলে নিয়ে চলা।আবার মাঝে মাঝেই বেরিয়ে পড়া।বইমেলায় সাহিত্য মেলায় দিল্লির বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যাওয়া।আমরা প্রায়শই এখন একসঙ্গে যাই।
পিথ্রি। আমিও একটা ফ্ল্যাট কিনলাম এই পাড়াতেই। কিছুদিন পর আমার মহুকুমার পরিচিত বিশিষ্ট বাচিক শিল্পী প্রণব দত্ত এসে জুটলো রিটায়ারমেন্টের পর।আমাদের তিনজনেরই নামের আদ্যাক্ষর ইংরেজি পি বলে নাম রাখলাম পিথ্রি। জমে উঠল আড্ডা। আমাদের তেতিশফুটা রোডে কবিতা পাঠ ও চা পান।করোনার সময় একটা কাজ হাতে নিলাম। “ দিল্লির নির্বাচিত বাংলা কবিতা” সংকলন। ২০২২ এর এপ্রিল মাসে একটা অনুষ্ঠান আয়োজন করা হলো এই পাড়ায়।দক্ষিণ-পশ্চিম দিল্লিতে বাংলা সাহিত্য চর্চার যাতে বাড়ে সেটা উদ্দেশ্য ছিল। তসলিমা নাসরিনের হাত দিয়ে প্রকাশ করা হলো সংখ্যাটি।পীযূষের যোগদান অন্যতম। আমরা উদ্বেল হয়ে উঠলাম। পরের বার আবার হলো এই অনুষ্ঠান।এবার দিল্লির আবৃত্তিকারদের জন্য একঘন্টা সময় আলাদা করে রাখা হয়।পীযূষ কিনে আনল এক রংয়ের তিনটি পাঞ্জাবী।আমাদের ট্রেডমার্ক। পীযূষের দাদা একবার তিন পিস একরঙা পাঞ্জাবীর কাপড় উপহার দিলেন। ব্যাস, আমাদের আর কে পায়! জয় বাংলা কবিতার জয় আমাদের স্লোগান।
হুজুগ উঠলো বাংলাদেশ যাবার। চট্টগ্রাম থেকে বিশিষ্ট কবি ইউসুফ ভাই আমন্ত্রণ জানালেন।ভিসা নেওয়া হলো।আনন্দে ভিসা নিয়ে ফেরার পথে প্রণব সাতশো টাকার কফি বিল মেটালো।আমি বহুবার গেলেও ওরা এই প্রথমবার বাংলাদেশ যাচ্ছে। প্রণবের আবার প্রচুর আত্মীয় স্বজনরা রয়েছেন। বিশেষ করে উল্লাপাড়ায় যেতেই হবে। ট্যুর প্ল্যানে দু’রাত রাখা হলো।নির্দিষ্ট দিনে রওনা হলাম। দিল্লি থেকে ফ্লাইটে ঢাকা। তবে প্রথমবার বাই রোড গেলে অনুভূতি অন্যরকম হয়। সেযাক, বাংলাদেশ সংখ্যা দেহলিজে বিস্তারিত লেখা হয়েছে। এখানে আর তুলে আনছি না। তবে পীযূষের কিছু বন্ধু আমার কমন বন্ধু ,তবুও ওর আয়োজন বিশেষ মনকাড়া।
ফেরার পথে দর্শনা সীমান্ত দিয়ে গেদে এসে বহিরগাছি পীযূষের বাড়ি এলাম।বাড়ির সবাই যেন তৈরি ছিলো আমাদের আপ্যায়ন করার জন্য।রাত কাটল গল্পগুজব করে। পরদিন সারাদিন সাহিত্য সমাবেশ হলো মধ্যাহ্ন ভোজসহ। এক অভূতপূর্ব আনন্দ নিয়ে ফিরে এলাম।
পীযূষ এবং দাদারা কামাল করে দেখালেন আমাদের সম্মানে।
আবার এক হুজুগ উঠলো উত্তরাখন্ডের রূদ্রপুর যেতে হবে। বহুদিন থেকে কথা চলছিল। নানান কথা। হরিদ্বার থেকে হেমন্তলোক পত্রিকার সম্পাদক শিবু মন্ডল যোগাযোগ করল,ওর আত্মীয় স্বজন আছেন শক্তিফার্মে। আমি খানিক ঢিলেমি দিলেও পীযূষ যাবেই সেখানে। বাংলা স্কুল খোলা হবে কবিতা পড়ানো হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। পাড়ার দোকান থেকে এক বান্ডিল বর্ণপরিচয় কেনা হলো। আমি আমার ঘরের বেশ কিছু বইপত্র সঙ্গে নিলাম।পীযূষের বড় গাড়িতে একসকালে পিথ্রি রওনা হলাম। গাড়ির মালিক চালক একজন। গাড়ি যে কত গতিতে চলছে বোঝাই যাচ্ছে না। শিবু মন্ডল ইতিমধ্যে পৌঁছে গেছে। আমরাও একসময় পৌঁছে গেলাম এবং মনে হলো এক বাংলায় এসেছি।জমিতে ধানচাষ দেখে অবাক হবার পালা।থাকা খাওয়ার পালা চলছে শিক্ষক চিত্তরঞ্জন সরকারের বাসভবনে। আতিথেয়তার শেষ নেই।
সন্ধ্যায় মিটিং হলো আগামীকালের কর্মসূচি নিয়ে। কবি প্রতাপ দত্ত পরদিন সব পরিচালনা করেন। আমরা উদ্বেল হলাম। ফেরার সময় কষ্ট হলেও পীযূষ রাত এগারোটার মধ্যে পৌঁছে দিল আমাদের তেতিশফুটায়।আমরা উল্লাসে বললাম - জয় বাংলা কবিতার জয়।
পীযূষ বয়সে ৫০ আর আমি ৭০ – আমাদের বাংলা সাহিত্যচর্চা করাটা এবং প্রসারিত করানো যেন একটা দায়বদ্ধতা।প্রয়াস সার্থক হোক। ওর সুখসমৃদ্ধি দীর্ঘ জীবন কামনা করি।
Tags:
ক্রোড়পত্র