পীযূষকান্তি বিশ্বাস,
আমার সামান্য যাত্রা
পীযূষকান্তি বিশ্বাস
জীবনের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে যখন পিছনে ফিরে তাকাই, তখন নিজেকে প্রায়শই দুটো সমান্তরাল স্রোতের মাঝে দাঁড়ানো এক অভিযাত্রী বলে মনে হয়। এক স্রোত প্রযুক্তির, যুক্তির, শৃঙ্খলার; অন্য স্রোত কবিতার, আবেগের, কল্পনার। আমি পীযূষকান্তি বিশ্বাস, এই দুই আপাত-বিপরীতমুখী জগতেরই এক বাসিন্দা। একদিকে একজন ক্লাউড আর্কিটেক্ট, অন্যদিকে আমার মন পড়ে থাকে বাংলা কবিতার শব্দে, ছন্দে, ভাবে। পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামের মেঠো পথ থেকে আমার যাত্রা শুরু হয়েছিল, জীবনের স্রোত আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে ভারতীয় বিমান বাহিনীর কঠোর অনুশাসনে, কর্মব্যস্ত কর্পোরেট জগতের জটিল আবর্তে, অবশেষে থিতু করেছে রাজধানী দিল্লির বুকে। এই দীর্ঘ পথচলার দিকে ফিরে তাকিয়ে আজ কিছু কথা বলার প্রয়াস করছি – আমার বেড়ে ওঠা, আমার স্বপ্ন, আমার সংগ্রাম, আমার সৃষ্টি আর আমার দর্শনের কথা। আমি দাঁড়িয়ে আছি দুটি ভিন্ন পৃথিবীর সঙ্গমস্থলে – একটি আমার জন্মভূমি, অন্যটি আমার কর্মভূমি, ভারতের কোলাহলমুখর রাজধানী দিল্লি। লোকে আমায় চেনে দিল্লির বাঙালি কবি হিসেবে। কিন্তু আমার সত্তার গভীরে আমি আজও সেই বহিরগাছির বালক, যার কানের কাছে তার বাবা জ্ঞানেন্দ্রনাথ বিশ্বাস বুনে দিয়েছিলেন জীবনের প্রথম ও প্রধান বীজমন্ত্র – ‘মানব সভ্যতার জন্য কিছু করে যেতে হবে’।
আমার বাবার দেওয়া শিক্ষা ছিল আক্ষরিক অর্থেই মাটির কাছাকাছি থাকার শিক্ষা। তিনি আমাকে ‘রাখাল বালকের পাঠ’, ‘সুবোধ বালকের পাঠ’ দিয়েছিলেন। তাঁর গ্রাম্য শিক্ষা, লালন ফকির বা দুদ্দু শাহের মতো দুনিয়ার মানুষদের প্রতি তাঁর সহজ শ্রদ্ধা, তাঁর অকৃত্রিম সরলতা আর চিন্তার বিশালতা – এই ছিল আমার শৈশবের পাওয়া সবচেয়ে বড় সম্পদ। বাবা শিখিয়েছিলেন কীভাবে ছিপ ফেলে ধৈর্য ধরে মাছ ধরতে হয়, শিখিয়েছিলেন জীবনের স্রোতে নিজের লক্ষ্য নিজেকেই স্থির করতে হয়। তাঁর সেই দর্শন – যা ছিল গ্রাম্য সারল্য আর বাউলিয়ানার এক আশ্চর্য মিশেল – আমাকে শিখিয়েছিল বৃহৎ পৃথিবীর স্বপ্ন দেখতে, কিন্তু শিকড়কে ভুলে না যেতে। তাঁরই দেওয়া সেই বীজ, সেই চিন্তা – মানব সভ্যতার জন্য কিছু করার – আমার সমস্ত জীবনকে অর্থ দিয়েছে, দিকনির্দেশনা দিয়েছে।
এই চিন্তার অঙ্কুরকে সযত্নে লালন করেছেন আমার অগ্রজ, পলাশকান্তি বিশ্বাস। তিনি ছিলেন আমার কাছে আধুনিক পৃথিবীর জানলা। বাবার দেওয়া দেশজ দর্শনের সঙ্গে তিনি পরিচয় করিয়ে দিলেন বিশ্ব সাহিত্যের বিশাল জগতের। তাঁর চোখ দিয়েই আমি প্রথম চিনলাম সুকুমার রায়ের ননসেন্স, জীবনানন্দের বিষণ্ণ প্রকৃতি আর রূপসী বাংলা, রবীন্দ্রনাথের ব্যাপ্তি আর গভীরতাকে। আমার কবিতা লেখার বীজমন্ত্র, আমার কাব্যের অনুপ্রেরণা সেখান থেকেই পাওয়া। অগ্রজের হাত ধরে আমি বুঝলাম, মানব সভ্যতায় অবদান রাখতে গেলে নিছক সদিচ্ছা যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন নিজেকে প্রস্তুত করা – জ্ঞান দিয়ে, দক্ষতা দিয়ে, সামাজিক সংযোগ তৈরি করে এবং সবচেয়ে জরুরি, নিজের একটি স্বচ্ছ বিশ্বাস ও দর্শন গড়ে তুলে।
কবিতা লেখার ইচ্ছে ছোটবেলায় ছিলো । সেইরকম কিছু চেষ্টা ছিলো না তা নয়, কিন্তু জীবন সংগ্রামের পথে, নিজেকে বাঁচিয়ে রাখাই ছিলো একটা চ্যালেঞ্জ । বাংলা সাহিত্যের সামান্য পাঠ নিয়ে বিভিন্ন ফোরামে দাঁড়িয়েছি । তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু হয়ে ওঠেনি । সংগ্রামটাই প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে । সাহিত্যের ভাষা, অক্ষর, বাক্যগঠন নিয়ে দূরে হরিয়ানভি, পাঞ্জাবীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দিল্লির রুক্ষভূমিতে করতে হয়েছে জমির লড়াই । আমার ‘শিক্ষা’ বলতে বাবার রাখাল বালকের পাঠ, অগ্রজের দেখানো সাহিত্যের পথ, বায়ুসেনার কঠোর শৃঙ্খলা ও প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ, পরবর্তীতে পাওয়া কবিতার মেন্টর বারীন ঘোষাল ও দীপঙ্করের দীক্ষা, পরবর্তী সময়ে কবি প্রাণজি বসাকের স্নেহধন্য হয়েছি । দিল্লির বুকে একা একা লড়াই করে বেড়ে ওঠা – এই সবকিছুই আমার শিক্ষার অঙ্গ। জীবনই আমার সবচেয়ে বড় কবিতা শিক্ষক। প্রতাপগড়ের সবুজ প্রান্তর থেকে বহিরগাছির পথ পেরিয়ে ব্যাঙ্গালোর, জম্মু-কাশ্মীর, জয়সলমীর হয়ে দিল্লির বুকে থিতু হওয়া – এই দীর্ঘ যাত্রা পথে অর্জিত প্রতিটি অভিজ্ঞতাই আমার জ্ঞানভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে, আমার দর্শনকে পরিশীলিত করেছে। আমি এমসিএ ডিগ্রি অর্জন করেছি, ক্লাউড আর্কিটেক্ট হিসেবে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করছি, তিনটি আমেরিকান পেটেন্ট অর্জন করেছি – এই প্রযুক্তিগত দক্ষতাকেও আমি আমার সামগ্রিক শিক্ষারই অংশ মনে করি, যা আমাকে সভ্যতার সেবায় নিজেকে প্রস্তুত করতে সাহায্য করেছে।
আমার কবিতা দর্শন আমার বাবার দেওয়া সেই মূল বীজকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত। ‘মানব সভ্যতার জন্য কিছু করে যেতে হবে’ – এই তাড়নাই আমার চালিকাশক্তি। তবে আমি বিশ্বাস করি, বিশাল বা যুগান্তকারী কিছু করতেই হবে, এমন কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। বরং ছোট ছোট পদক্ষেপে, নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী, এমন কিছু করা যা মানুষের কাজে লাগে, যা প্রচলিত ব্যবস্থাকে হয়তো সামান্য হলেও উন্নত করে – সেটাই আমার কাছে শ্রেয়। আমার দর্শন হলো ‘আপন জ্ঞানে’ সঠিক কাজটি করা। অন্যের অনুকরণ নয়, নিজের বোধ, বিশ্বাস ও জ্ঞান দিয়ে বিচার করে পথ চলা। দিল্লিতে আমার বেড়ে ওঠা অনেকটা আগাছার মতো – প্রতিকূলতার মধ্যেই নিজের মতো করে জায়গা করে নেওয়া, নিজস্ব ভঙ্গিতে বিকশিত হওয়া। এই দর্শন আমার কবিতায়, আমার প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনে, এমনকি আমার সম্পাদিত পত্রিকার মধ্যেও প্রতিফলিত হয়। প্রযুক্তি আর কবিতা, এই দুই আপাত বিপরীতমুখী জগৎকে আমি একত্রিত করার চেষ্টা করি, কারণ আমি বিশ্বাস করি, মানব সভ্যতার অগ্রগতির জন্য বিজ্ঞানমনস্কতা ও মানবিক সংবেদনশীলতা – উভয়েরই প্রয়োজন।
কবিতা আমার কাছে আত্মপ্রকাশের মাধ্যম, আমার দর্শনের প্রতিধ্বনি। পলাশদার হাত ধরে যে কাব্যজগতের সঙ্গে পরিচয়, তাকে আমি নিজের মতো করে আত্মস্থ করার চেষ্টা করেছি। আমার কবিতা ‘বাধা নই রক্ত’, ‘ঘুমঘর’ বা ‘আকাশচুম্বন’-এ উঠে আসে গ্রাম বাংলার স্মৃতি, শহুরে জীবনের জটিলতা, প্রযুক্তির প্রভাব, প্রেম, প্রকৃতি, প্রবাসী মনের শিকড়ের টান আর সামাজিক দায়বদ্ধতার কথা। আমার কবিতা নিছক শব্দচর্চা নয়, তা আমার জীবনদর্শন ও অভিজ্ঞতার নির্যাস। আমি চেষ্টা করি আমার কবিতায় এমন কিছু বলতে, যা হয়তো পাঠকের মনে সামান্য হলেও অনুরণন তুলবে, তাকে ভাবাবে, হয়তো বা মানব মনের কোনও গভীরতর সত্যকে ছুঁয়ে যাবে। আমি মনে করি, কবিতাও সভ্যতার অগ্রগতির একটি সূক্ষ্ম কিন্তু শক্তিশালী হাতিয়ার। এটি মানুষের সংবেদনশীলতাকে বাঁচিয়ে রাখে, তাকে যন্ত্র হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করে।
মানব সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া – এই ভাবনাটি আমার সমস্ত কাজের কেন্দ্রে থাকে। আমি যখন ক্লাউড আর্কিটেক্ট হিসেবে কাজ করি, নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করি বা পেটেন্টের জন্য আবেদন করি, তখনও আমার অবচেতনে বাবার দেওয়া সেই বীজমন্ত্র কাজ করে। প্রযুক্তিকে আমি কেবল পেশা হিসেবে দেখি না, দেখি মানব জীবনকে সহজতর করার, আরও উন্নত করার একটি উপায় হিসেবে। আবার যখন আমি কবিতা লিখি, বা ‘দেহলিজ’-এর মতো একটি ওয়েবজিন সম্পাদনা করে নতুন লেখক-কবিদের জন্য একটি মঞ্চ তৈরি করি, তখনও আমার লক্ষ্য থাকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলকে সমৃদ্ধ করা, যা প্রকারান্তরে সভ্যতারই সেবা। ‘লিপিকা’-র মতো বাংলা টাইপিং সফটওয়্যার তৈরি বা ‘কম্পিউটার এইডেড পোয়েট্রি’-র মতো উদ্যোগ নেওয়ার পিছনেও এই চিন্তাই কাজ করেছে – প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে কীভাবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে আরও সহজলভ্য ও আকর্ষণীয় করে তোলা যায়, কীভাবে ডিজিটাল যুগে এর প্রাসঙ্গিকতা বজায় রাখা যায়। আমার কাছে, সভ্যতা কেবল ইট-কাঠ-পাথরের উন্নতি নয়, তা মানুষের মনন, শিল্প, সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান – এই সবকিছুর সামগ্রিক বিকাশ। আমি আমার ক্ষুদ্র সামর্থ্যে সেই বিকাশে সামান্য কিছু যোগ করতে পারলেই নিজেকে সার্থক মনে করব।
শৈশব
আমার জন্ম ১৯৭৫ সালের ১৫ই মে, নদীয়া জেলার এক অখ্যাত, কিন্তু সবুজে মোড়া গ্রাম প্রতাপগড়ে। বাবা জ্ঞানেন্দ্রনাথ বিশ্বাস, মা করুণাময়ী বিশ্বাস। গ্রাম বাংলার সেই চিরায়ত প্রকৃতির কোলেই আমার বেড়ে ওঠা – খোলা মাঠ, পুকুর, দিগন্তজোড়া ধানক্ষেত, নির্মল বাতাস। শৈশব ছিল বাঁধনহারা, দুরন্তপনায় ভরা। পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলার প্রতি ছিল তীব্র আকর্ষণ, বিশেষ করে ক্রিকেট। বহিরগাছি বা বগুলার হয়ে মাঠে নামার স্মৃতি আজও টাটকা। গ্রামের পোস্ট অফিস ছিল কাছের হাট বহিরগাছিতে, সেই নামটাও জড়িয়ে আছে আমার অস্তিত্বের সঙ্গে।
মাধ্যমিক পাশ করে রানাঘাট কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু নিয়তি আমাকে টেনে নিয়ে গেল সম্পূর্ণ অন্য পথে। ১৯৯৩ সাল, বয়স মাত্র সতেরো, গায়ে হাফ প্যান্ট। গ্রাম ছেড়ে, চেনা পরিবেশ ছেড়ে পাড়ি দিলাম ব্যাঙ্গালোরে, ভারতীয় বিমান বাহিনীতে যোগ দিতে। জালাহাল্লির এয়ার ফোর্স স্টেশন। বাংলা ভাষা থেকে দূরে, বাঙালি সংস্কৃতি থেকে দূরে, পরিবার-পরিজনহীন এক কিশোরের কাছে এ ছিল এক বিরাট ধাক্কা, এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। ১৯৯৪ সালে আমার পোস্টিং হলো আরও দূরবর্তী এবং সংঘাতময় পরিবেশে – জম্মু ও কাশ্মীরে। তখন সবে হয়তো গোঁফ কামানো শুরু করেছি, পৃথিবীর জটিল সমীকরণ তখনও আমার কাছে প্রায় অজানা। আর আমি, এক তরুণ সৈনিক, দাঁড়িয়ে আছি এক উত্তপ্ত ভূখণ্ডে, যেখানে বাতাসে বারুদের গন্ধ, যেখানে জীবনের অনিশ্চয়তা প্রতি মুহূর্তে সঙ্গী। অগ্রজ কবি প্রশান্ত বারিক যেমনটা বলেছেন, এ যেন "এক ফাটা চৌচির বোমের সামনে এক তরুন সৈনিকের অবস্থান"। দেশের সুরক্ষার গুরুদায়িত্ব, প্রতিকূল পরিবেশ, ভাষার ব্যবধান – সব মিলিয়ে এক তীব্র মানসিক চাপ আর টানাপোড়েন।
কিন্তু অদ্ভুতভাবে, এই কঠিন বাস্তবতার মধ্যেই আমার ভেতরের সংবেদনশীল সত্তাটা জেগে উঠেছিল। সেই চাপ, সেই একাকিত্ব, সেই অভিজ্ঞতাগুলোই হয়তো অজান্তে জন্ম দিয়েছিল আমার প্রথম কবিতার। আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'বাধা নয় রক্ত'-তে স্থান পাওয়া "অস্ত্র সমর্পণ" কবিতাটি সেই সময়েরই ফসল:
অস্ত্র সমর্পণ
করবো না মার্চ আর যাব নাকো ফ্রন্টে / শান বাঁধা রানওয়ে হোক উত্তপ্ত / নুন খেয়ে ধরি গান আরক্ত কণ্ঠে / বাঁধা হাত, বাঁধা মাথা, বাঁধা নয় রক্ত ।
লেফট রাইট পায়ে পায়ে বিদীর্ণ পৃথ্বী / পরমাণু বিক্রিয়ায় উবে যায় গন্ধ / করি নাকো পরোয়া সৈনিক বৃত্তি / মৃত্তিকার চুম্বনে হয় হোক বন্ধ ।
অপরাধ শিকারির, শিকার অনুতপ্ত / রক্তবীজের ঝাড় কুরুকুল বংশ / কার যুদ্ধ ? সীমা কার ? মাটি অভিশপ্ত / কার ভ্রান্ত প্রশ্নে দুপক্ষই ধ্বংস ?
হিমবাহ সত্য, ত্রেতা গলে সিন্ধু / যুগান্তর ভাঙ্গছে, দুপাড়েই গঙ্গা / প্রবাহ তো মানুষের - মুসলিম, হিন্দু / ওপারে সবুজ চাঁদ এপারে ত্রিরঙ্গা ।
আজ এতদিন পরেও কবিতাটা পড়লে অনুভব করি সেই তরুণ মনের আকুতি – যুদ্ধের ভয়াবহতা, সীমান্তের বিভেদকে অস্বীকার করে সে মাটির টানে ফিরতে চায়, জীবনের গান গাইতে চায়। সে বুঝতে পারে, বাহ্যিক সমস্ত বাঁধন তুচ্ছ, মানুষের ভেতরের সত্তা, তার রক্তের প্রবাহ অবিনশ্বর। ধর্ম বা কাঁটাতারের ঊর্ধ্বে উঠে সে মানুষের অখণ্ড মানবিক প্রবাহকেই সত্য বলে জানতে চায়। হয়তো এই বোধটাই আমাকে পরবর্তী জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে পথ চলতে সাহায্য করেছে। বিমান বাহিনীর কঠোর শৃঙ্খলা আমাকে যেমন নিয়মানুবর্তিতা শিখিয়েছে, তেমনই সেই নির্জন প্রবাস আমার ভেতরের কবিসত্তাকে লালন করেছে। এই সময়েই আমি এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম অপারেটর (ADSO), কার্টোগ্রাফি এবং পরে ইলেকট্রনিক ডেটা প্রসেসিং (EDP) সেলে সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টের কাজও শিখি ও করি, যা আমার প্রযুক্তিমনস্কতার ভিত্তি স্থাপন করে।
দিল্লি
১৯৯৮ সালের অক্টোবর। বদলি হয়ে এলাম নতুন দিল্লিতে, পালাম এয়ারফোর্স স্টেশনে। দেশের রাজধানীতে শুরু হলো জীবনের আরেক নতুন পর্ব। একদিকে বিমান বাহিনীর দায়িত্ব, অন্যদিকে দিল্লির কর্মব্যস্ত জীবন। কিন্তু এর মাঝেই আমি খুঁজে নিয়েছিলাম নিজের জ্ঞানচর্চার পথ। কাজের ফাঁকে ভর্তি হলাম ইন্দিরা গান্ধী ন্যাশনাল ওপেন ইউনিভার্সিটিতে (IGNOU)। দূরশিক্ষার মাধ্যমে শুরু করলাম মাস্টার অফ কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশনস (MCA)। বায়ুসেনার চাকরির পাশাপাশি এই ডিগ্রি অর্জন করাটা সহজ ছিল না, কিন্তু জেদ আর অধ্যবসায় আমাকে সাফল্য এনে দিয়েছিল। ২০০৩ সালে আমি সফলভাবে এমসিএ ডিগ্রি লাভ করি।
দিল্লিতে আসার পরই আমার ব্যক্তিগত জীবনও পূর্ণতা পায়। ২০০০ সালের জুলাই মাসে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হই বিউটি বিশ্বাসের সঙ্গে। নদীয়ার বাগুলার মেয়ে, আমার জীবনের সবচেয়ে বড় শক্তি ও অনুপ্রেরণা। ২০০৪ সালের জুন মাসে আমাদের ঘর আলো করে আসে পুত্র ঋজুস্মিত। তখন আমার পোস্টিং ছিল রাজস্থানের জয়সলমীরে। পিতার দায়িত্ব কাঁধে আসায় জীবনের প্রতি দায়বদ্ধতা যেন আরও বেড়ে গেল।
কর্মসূত্রে বিভিন্ন জায়গায় থাকলেও, দিল্লিই ধীরে ধীরে হয়ে উঠলো আমার স্থায়ী ঠিকানা। ২০০৫ সালের এপ্রিল মাসে সপরিবারে এসে উঠলাম দিল্লির মহাবীর এনক্লেভ অঞ্চলের একটি ভাড়া বাড়িতে। এই এলাকাটি তখন ধীরে ধীরে প্রবাসী বাঙালিদের একটি পরিচিত কলোনি হিসেবে গড়ে উঠছে। মহাবীর এনক্লেভে আসার পর এখানকার বাঙালি কমিউনিটির সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার সঙ্গে আমি স্বাভাবিকভাবেই জড়িয়ে পড়ি। মিনতি-দির স্মৃতিচারণ অনুযায়ী, ২০০৬ বা ২০০৭ সাল নাগাদ তাঁদের সঙ্গে আমার পরিচয়। তখন শ্রদ্ধেয় দিলীপ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় এখান থেকে 'কথাঞ্জলি' নামে একটি লিটল ম্যাগাজিন বের হতো এবং নিয়মিত 'সাহিত্যবাসর' বসতো। আমি কিছুটা লাজুকভাবেই তাঁদের কাছে গিয়েছিলাম, বাংলা ভাষার প্রতি আমার ভালোবাসার কথা জানিয়েছিলাম, তাঁদের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলাম। আমার আন্তরিকতা দেখে দিলীপবাবু, মিনতি-দি সহ সাহিত্যবাসরের সকলেই আমাকে আপন করে নিয়েছিলেন।
খুব তাড়াতাড়ি আমি তাঁদের সাহিত্য পরিবারের একজন হয়ে উঠি। কেবল শ্রোতা হিসেবে নয়, জড়িয়ে পড়ি সাংগঠনিক কাজেও। 'কথাঞ্জলি' পত্রিকার কোষাধ্যক্ষের দায়িত্ব দেওয়া হয় আমাকে, যা আমি দীর্ঘকাল (প্রায় ২০০২ থেকে ২০১২ পর্যন্ত) নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করার চেষ্টা করেছি। এই সময়েই আমি আবার নিয়মিত কবিতা লেখা শুরু করি। আমার প্রথম কবিতা 'কথাঞ্জলি'তেই প্রকাশিত হয়েছিল, যা আমাকে দিয়েছিল এক অনাবিল আনন্দ আর আত্মবিশ্বাস। দিলীপবাবুর মতো একজন অভিজ্ঞ সম্পাদকের স্নেহ, সান্নিধ্য ও উৎসাহ আমার সাহিত্য যাত্রার প্রথম দিনগুলোতে পাথেয় হয়েছিল। মিনতি-দি, জয়শ্রী রায়, স্বপ্না ব্যানার্জি, ঝর্ণা ভট্টাচার্য, গোপাল চন্দ্র পাল, ধনঞ্জয় ঘাঁটি, শান্তি সরকার – এই মানুষগুলোর সঙ্গে আমার সাহিত্যিক সখ্য গড়ে ওঠে। শুধু সাহিত্যবাসর নয়, এখানকার বাংলা ক্লাস বা অন্যান্য সাংস্কৃতিক উদ্যোগে সাধ্যমতো পাশে থাকার চেষ্টা করতাম। এই আন্তরিক ও উষ্ণ সাহিত্যিক পরিমণ্ডলই আমার ভেতরের কবিসত্তাকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল।
কবিতা
বেশ কয়েক বছর ধরে লেখার পর মনে হলো, লেখাগুলোকে গ্রন্থাকারে ধরে রাখা দরকার। ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সম্পূর্ণ নিজের উদ্যোগে, নিজের খরচে প্রকাশ করলাম আমার প্রথম কবিতার বই 'বাধা নয় রক্ত'। কোনো নামী প্রকাশক নয়, নিজের কম্পিউটারে টাইপ করে, প্রিন্ট-আউট নিয়ে বই। কিন্তু এই অনাড়ম্বর প্রকাশের মধ্যেও ছিল এক বিরাট প্রাপ্তি – বইটির অমূল্য ভূমিকাটি লিখে দিয়েছিলেন আমার সাহিত্য জীবনের প্রথম গুরু, শ্রদ্ধেয় দিলীপ কুমার ব্যানার্জি। তাঁর সেই আশীর্বাদ আমার কাছে ছিল গুরুত্বপূর্ণ ।
এরপর দিল্লির বাংলা সাহিত্য জগতে আমার বিচরণ বাড়তে থাকে। ২০১২ সালে পরিচিত হলাম 'দিল্লি হাটার্স' নামে এক নবীন ও প্রাণবন্ত সাহিত্য গোষ্ঠীর সঙ্গে। সৌজন্যে, জয়শ্রী রায় । সেখানে পেলাম অরূপ চৌধুরী, কৃষ্ণা মিশ্র ভট্টাচার্য, অগ্নি রায়, দিলীপ ফৌজদার, প্রশান্ত বারিকের (প্রশান্ত-দা) মতো অগ্রজ ও সমসাময়িক কবি-লেখকদের সান্নিধ্য। তাঁদেরই উদ্যোগে ২০১৪ সালের মার্চ মাসে প্রকাশিত হলো আমার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ 'ঘুমঘর'। বইটির প্রকাশক ছিলেন গোষ্ঠীরই অন্যতম সদস্য, আমার বন্ধু দিলীপ ফৌজদার। এই বইটি দিল্লির সাহিত্য মহলে বেশ কিছুটা পরিচিতি এনে দিয়েছিল।
এর দু'বছর পর, ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, আমার সাহিত্য জীবনে এলো আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়। পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম পরিচিত প্রকাশনা সংস্থা 'অভিযান পাবলিশার্স' আমার তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ 'আকাশচুম্বন' প্রকাশ করতে রাজি হলো। কলকাতা থেকে বই প্রকাশের মাধ্যমে আমি পশ্চিমবঙ্গের বৃহত্তর পাঠক সমাজের কাছে পৌঁছনোর একটা সুযোগ পেলাম। আমার এই গ্রন্থখানি পাঠ করে বিভিন্ন সমালোচক ও কবির কাছ থেকে উষ্ণ অভ্যর্থনা লাভ করেছে। তাঁদের রিভিউগুলি বইটির স্বতন্ত্রতা এবং সমকালীন বাংলা কবিতায় এর গুরুত্বকে তুলে ধরেছে। সামগ্রিক মূল্যায়ন: প্রায় সকলেই 'আকাশচুম্বন'-কে সমকালীন বাংলা কবিতার একটি গুরুত্বপূর্ণ ও অবশ্যপাঠ্য সংযোজন হিসেবে বিবেচনা করেছেন। সোনালী মিত্র ও দীপঙ্কর দত্ত পীযূষকান্তিকে একজন স্বতন্ত্র ও সম্ভাবনাময় কবি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, যার কাছ থেকে পাঠকরা ভবিষ্যতে আরও অনেক ভালো কবিতার আশা রাখেন। বারীন ঘোষাল বইটিকে "চমৎকার" এবং রাহুল গাঙ্গুলী একে ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক বলেছেন।
দেহলিজ
দিল্লি এমনিতেই অবাঙালি বাঙালিপরিবেশ । এখানে, পশ্চিমবঙ্গ থেকে মানুষ রোজগারের সন্ধানেই বেশী আসেন । অনেকেই পাকাপাকি ভাবে থেকে যান । যেহেতু, বাংলা সাহিত্যের চর্চা করি , অনেকের সঙ্গে মেলামেশা করতে হয় । তারা আমাদের দিল্লির বাঙালিদের লেখা পড়ে বলেন, দিল্লিতে কিছু নেই । কিছু হবে না । বাংলা নিয়ে কাজ করতে হলে কলকাতায় শিফট করতে হবে ।
তো যেখানে আমি থাকি, আমার জীবন দর্শন অনুযায়ী তা গড়ে নেবার দাযিত্ব আমার । এখানে কোন রাষ্ট্রনেতাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই । আমিও তো এই দেশের নাগরিক, আমারও তো কিছু দায় আছে, আমি কি করতে পারি ?
আমি, কবিতা লেখার পাশাপাশি সাহিত্য সংগঠন ও সম্পাদনার কাজে আগ্রহী হয়ে পড়লাম । 'কথাঞ্জলি'র সঙ্গে যুক্ত থাকার সময়েই এর প্রতি আমার আগ্রহ জন্মায়। পরবর্তীকালে পালাম কলোনি থেকে গোপাল চন্দ্র পাল সম্পাদিত 'প্রতিভা পথিকৃৎ' পত্রিকার (২০১২-২০১৬) সঙ্গে যুক্ত ছিলাম, মূলত পৃষ্ঠপোষক হিসেবে। এই সময় আমার পরিচয় হয়, দিল্লির দরবেশ কবি প্রাণজি বসাকের সঙ্গে । আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন দীপক প্রকাশনীর গোপাল চন্দ্র পাল ২০১৬-১৭ সালে অল্প সময়ের জন্য দিল্লির ঐতিহ্যবাহী বেঙ্গল অ্যাসোসিয়েশনের মুখপত্র 'দিগঙ্গন' পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হিসেবে কাজ করার সুযোগও হয়েছিল।
তবে আমার সম্পাদনা জীবনের এক গভীর আবেগ ও দায়বদ্ধতার জায়গা জুড়ে আছে 'শূন্যকাল' ওয়েব ম্যাগাজিন। আমার অকালপ্রয়াত বন্ধু, কবি দীপঙ্কর দত্ত এই ম্যাগাজিনটি শুরু করেছিল। ২০১৬ সালে তার আকস্মিক মৃত্যুর পর যখন এর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত, তখন আমি এগিয়ে এসেছিলাম। বন্ধুর স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে, তার কাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে আমি ২০১৬ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে 'শূন্যকাল'-এর সম্পাদনা করেছি।
'শূন্যকালে'র অভিজ্ঞতা আমাকে নিজের একটি পত্রিকা শুরু করতে অনুপ্রাণিত করে। ২০১৮ সালে আমি শুরু করি আমার স্বপ্নের ওয়েব ম্যাগাজিন – 'দেহলিজ'। নামটি বিশেষ ভাবে বেছে নেওয়া – দিল্লির প্রতি ইঙ্গিত, আবার সাহিত্য জগতে প্রবেশের দ্বারও বটে। এই পত্রিকার সূচনালগ্নের কথা মনে পড়লে আজও শিহরিত হই। এক রবীন্দ্রজয়ন্তীর সন্ধ্যায় এর পথচলা শুরু হয়েছিল, সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মোনালী রায়, সোনালি মিত্র, অগ্নি রায়, দিলীপ ফৌজদার, চৈতালী দাশ, কৌশিক সেন, মনীষা করের মতো অনেক সাহিত্যপ্রেমী বন্ধু। 'দেহলিজ' খুব অল্প সময়েই দেশ-বিদেশের লেখক ও পাঠকদের কাছে পরিচিতি ও ভালোবাসা লাভ করেছে। আমি চেষ্টা করি অত্যন্ত যত্ন সহকারে এটি সম্পাদনা করতে। পরে পাঠকদের ভালোবাসায় 'নির্বাচিত দেহলিজ' নামে এর মুদ্রিত সংস্করণও প্রকাশিত হয়েছে। 'দেহলিজ' আমার কাছে শুধু একটি পত্রিকা নয়, এটি দিল্লি তথা ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বাঙালি লেখক-কবিদের জন্য একটি উন্মুক্ত মঞ্চ তৈরি করার প্রয়াস।
'দেহলিজ'কে কেন্দ্র করে আমি নিয়মিত সাহিত্য আড্ডার আয়োজন করি, যেখানে আমরা মিলিত হই, নিজেদের লেখা পড়ি, আলোচনা করি। এছাড়া 'দিল্লির বাংলা সাহিত্য' নামে একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপও চালাই, যা দিল্লির সাহিত্যপ্রেমীদের কাছে এক ভার্চুয়াল মিলনক্ষেত্র হয়ে উঠেছে।
পেশা
আমার জীবনের অন্য ধারাটি হলো প্রযুক্তি। বিমান বাহিনীতে থাকাকালীনই এর সঙ্গে আমার সখ্য গড়ে ওঠে। এয়ার ডিফেন্স অপারেশন, কার্টোগ্রাফি থেকে সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট – নানা ক্ষেত্রেই কাজ করার অভিজ্ঞতা হয়েছে।জম্মু ও কাশ্মীরে থাকাকালীন গ্যাটের পয়সা খরচ করে, আপটেক থেকে প্রথম ১৯৯৬ সাল নাগাদ প্রথম ডিপ্লোমা করি । বিমান বাহিনী থেকে অবসর নেওয়ার পর আমি পুরোপুরি কর্পোরেট জগতে প্রবেশ করি। প্রথমে যোগ দিই 'ইনফোগেইন'-এ। এই সংস্থার কাজেই ২০০৭ সালে প্রথম আমেরিকায় (মিশিগান) যাই। আন্তর্জাতিক কর্মপরিবেশের সঙ্গে সেটাই প্রথম পরিচয়। এরপর কাজ করেছি 'পেরোট সিস্টেমস'-এ (পরে ডেল অধিগ্রহণ করে), যার সূত্রে ২০০৮ সালে লন্ডন যাই। পরে যোগ দিই বিশ্বখ্যাত প্রযুক্তি সংস্থা 'ডেল'-এ। ২০১২ সালে ডেল-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্লাউড সিস্টেম তৈরির প্রজেক্টে কাজ করতে আবার আমেরিকায় (টেক্সাস) যাই। এই সময়ে ক্লাউড কম্পিউটিং-এর মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে আমার দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা বাড়ে।
আমেরিকা থেকে ফিরে আমি যোগ দিই আর এক বিশ্বসেরা সংস্থা 'আইবিএম'-এ। বর্তমানে আমি আইবিএম-এই ক্লাউড আর্কিটেক্ট হিসেবে কর্মরত। প্রযুক্তির জগতে প্রতিনিয়ত নতুন কিছু শেখা, নতুন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করা – এটাই আমার পেশাগত জীবনের চালিকাশক্তি।
আমার প্রযুক্তিগত কাজের একটি বড় স্বীকৃতি হলো আমার নামে থাকা তিনটি আমেরিকান পেটেন্ট (USPTO)। নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য এই পেটেন্টগুলি পাওয়া আমার কাছে অত্যন্ত গর্বের ও আনন্দের। এছাড়া আমি দশটি টেকনিক্যাল পাবলিকেশন ও পেপারও লিখেছি। পেশাগত জীবনের এই অর্জন আমাকে গুরুগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে বক্তৃতা দেওয়ার বিরল সম্মানও এনে দিয়েছে।
দুই ভুবন
অনেকেই অবাক হন, কীভাবে আমি প্রযুক্তি আর সাহিত্যের মতো দুটি ভিন্ন জগতের মধ্যে ভারসাম্য রাখি। আমার কাছে কিন্তু এই দুটি জগৎ ততটা ভিন্ন বা বিপরীতমুখী নয়। বরং আমি চেষ্টা করি এদের মধ্যে একটা সেতু তৈরি করতে। আমার প্রযুক্তিগত জ্ঞানকে আমি সচেতনভাবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের কাজে লাগানোর চেষ্টা করি।
প্রয়াত বন্ধু দীপঙ্করকে আমি 'শূন্যকাল' ওয়েব ম্যাগাজিনটি প্রযুক্তিগতভাবে তৈরি করতে সাহায্য করেছিলাম। আমার নিজের পত্রিকা 'দেহলিজ'-এর পরিকল্পনা ও পরিচালনায় আমার প্রযুক্তিগত জ্ঞান অবশ্যই কাজে লেগেছে। বাংলা টাইপিং সহজ করার জন্য আমি 'লিপিকা' (Lipika) নামে একটি সফটওয়্যার তৈরি করেছি, যা ইংরেজি কিবোর্ড ব্যবহার করে ইউনিকোড বাংলায় লেখার সুবিধা দেয়। এছাড়া আমি 'কম্পিউটার এইডেড পোয়েট্রি' নিয়েও কিছু পরীক্ষানিরীক্ষা করেছি – প্রযুক্তির সাহায্যে বাংলা কবিতার ছন্দ, মিল বিশ্লেষণ বা এমনকি কবিতা নির্মাণে সহায়তা করা যায় কিনা, তা খতিয়ে দেখেছি। অগ্রজ কবি প্রশান্ত-দা তাঁর লেখায় আমার ফ্ল্যাটে বসে এই রকম একটি সফটওয়্যারের ডেমো দেখার অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করেছেন। আমার বিশ্বাস, প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার সাহিত্যের বিকাশেও সহায়ক হতে পারে, একে নতুন প্রজন্মের কাছে আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে পারে। আমি সেই চেষ্টাই করে চলেছি।
রাজনীতি
কবি লেখক ও সম্পাদক হিসাবে, অনেকে জিজ্ঞাসা করেন আমি কি বিজেপি ? নাকি তৃণমূল ? সক্রিয় বা দলীয় রাজনীতির সঙ্গে আমার প্রত্যক্ষ সংযোগ নেই, এবং রাজনৈতিক তত্ত্ব বিষয়েও আমার জ্ঞান সীমিত। আমি কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের সমর্থক নই। আমার রাজনৈতিক পছন্দ বা সমর্থন নির্ধারিত হয় কিছু মৌলিক নীতির ভিত্তিতে। আমি সেই রাজনৈতিক ধারা বা নেতৃত্বকেই সমর্থন করি যা মানব সভ্যতার সামগ্রিক অগ্রগতিকে চালিত করার কথা বলে এবং সেই লক্ষ্যে কাজ করে। আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি হলো: বিজ্ঞান চর্চার প্রসার, গণিত শিক্ষার উপর জোর, উন্নত ও আধুনিক পরিকাঠামো নির্মাণ (বিশেষত সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা) এবং দেশের নাগরিকদের দক্ষতা বৃদ্ধি (স্কিল ডেভেলপমেন্ট)। যারা এই গঠনমূলক বিষয়গুলিতে মনোনিবেশ করে, আমি স্বাভাবিকভাবেই তাদের প্রতি আকৃষ্ট হই।
তবে আমার পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, বর্তমান রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে কোনোটিই এই আদর্শগুলিকে নিখুঁতভাবে অনুসরণ করে না। তাই, কার্যক্ষেত্রে কোনো দল বা সরকারের মূল্যায়ন করার সময় আমি দেখি, কারা দেশের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জনে (উপার্জন বৃদ্ধি) বেশি মনোযোগী, এবং কারা অপ্রয়োজনীয় ঋণ গ্রহণ বা অপব্যয়ের খরচার মাধ্যমে সাময়িক জনপ্রিয়তা অর্জনের চেষ্টা করছে।
রাজনীতিতে আমি ব্যক্তিগত আক্রমণ, কাদা ছোড়াছুড়ি বা যেকোনো ধরনের নেতিবাচক প্রচারণার ঘোর বিরোধী। আমি মনে করি, এই ধরনের কার্যকলাপ দেশের অগ্রগতির পথে অন্তরায় সৃষ্টি করে এবং এতে দেশের প্রকৃত কল্যাণ সাধিত হয় না। আমি ইতিবাচক এবং প্রোডাক্টিভ বা উৎপাদনশীল রাজনীতির পক্ষে।
শেকড়ের সন্ধান
আমার জীবনের চালিকাশক্তি কী? এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো খুব সরল নয়। তবে বাবার দেওয়া সেই শিক্ষা – "মানব সভ্যতার জন্য কিছু করে যেতে হবে" – এটা আমার গভীরে প্রোথিত। আমি বিশ্বাস করি, খুব বড় কাজ করার প্রয়োজন নেই, কিন্তু যে কাজটা মানুষের কাজে লাগে, সমাজের মঙ্গল হয়, সেটা নিজের জ্ঞান-বুদ্ধি-বিশ্বাস অনুযায়ী নিষ্ঠার সঙ্গে করা উচিত। আমার বেড়ে ওঠাটা অনেকটা আগাছার মতো – কোনও পরিকল্পিত পরিচর্যা ছাড়াই, পারিপার্শ্বিক থেকে রসদ সংগ্রহ করে নিজের মতো করে মাটি আঁকড়ে টিকে থাকা আর বেড়ে ওঠা। এই পথচলায় আমি অনেকের কাছে ঋণী – আমার বাবা, আমার দাদা, আমার স্ত্রী, আমার বন্ধুরা। সাহিত্যের পথে আমাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছেন ও পথ দেখিয়েছেন অগ্রজ কবি বারীন ঘোষাল এবং আমার অকালপ্রয়াত বন্ধু দীপঙ্কর দত্ত। তাঁদের কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ। আমি চেষ্টা করি আমার নিজস্বতা বজায় রেখে কাজ করতে, স্রোতে গা ভাসিয়ে না দিয়ে নিজের বিশ্বাস অনুযায়ী চলতে।
জীবনের এই দীর্ঘ পথে আমি অনেকের ভালোবাসা, স্নেহ, সাহায্য ও অনুপ্রেরণা পেয়েছি। আমার বাবা-মা, দাদা, আমার স্ত্রী বিউটি – যে আমার সব সৃষ্টির নীরব সাক্ষী ও সবচেয়ে বড় সমর্থক, আমার পুত্র ঋজুস্মিত – এরা আমার জীবনের নোঙর। বহিরগাছির সেই প্রত্যন্ত গ্রামের বালক আজ দিল্লির বুকে দাঁড়িয়ে। পথটা সহজ ছিল না, আজও নেই। কিন্তু বাবার দেওয়া সেই রাখাল বালকের পাঠ, অগ্রজের দেখানো আলো, নিজের লড়াই আর জীবন থেকে পাওয়া শিক্ষা আমাকে পথ দেখিয়েছে। আমি আজও শিখছি, আজও নিজেকে প্রস্তুত করছি – মানব সভ্যতার জন্য আরও কিছু করার আশায়। আমার কবিতা, আমার দর্শন, আমার প্রযুক্তিগত জ্ঞান – এই সবকিছুকে মিলিয়ে আমি আমার নিজস্ব পথে চলতে চাই, সেই পথে, যা বৃহৎ না হলেও অর্থপূর্ণ, যা মানুষের কাজে লাগে, যা সভ্যতাকে হয়তো এক কণা হলেও এগিয়ে নিয়ে যায়। আমি এভাবেই বিকশিত হতে চেয়েছি, এভাবেই বাঁচতে চেয়েছি।
পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে এসে মনে হয়, পথ চলা এখনও বাকি। প্রযুক্তি ও কবিতা – এই দুই জগৎকে সঙ্গে নিয়েই আমি এগিয়ে যেতে চাই। প্রযুক্তির মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে আরও ছড়িয়ে দিতে চাই, আর কবিতার মাধ্যমে ছুঁতে চাই মানুষের মন, মানুষের অন্তর। বাবার দেওয়া সেই বীজ – মানব সভ্যতার জন্য কিছু করার – তাকে মহীরুহে পরিণত করার স্বপ্ন দেখি। জানি না কতটা পারব, কিন্তু চেষ্টা চালিয়ে যাব আমার শেষ দিন পর্যন্ত। এই নিরন্তর অভিযাত্রাই হয়তো আমার জীবন। সকলের ভালোবাসা ও আশীর্বাদ যেন আমার সঙ্গে থাকে।
Tags:
ক্রোড়পত্র
পঞ্চাশের যুবক পীযূষকান্তি বিশ্বাসের জন্য অনেক অনেক শুভেচ্ছা। লেখাটা পড়লাম। খুব আন্তরিক একটা জীবনকথা। লেখকের সাথে আমার আরো একটা মিল, আমিও নদীয়াবাসী, কল্যানী /
ReplyDeleteকাঁচড়াপাড়া অঞ্চলের ছেলে, যদিও দীর্ঘ কাল পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে ভিন প্রদেশে আছি। পরিশেষে অভিনন্দন জানাই দেহলিজ এর এই সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রচেষ্টাকে।