শর্মিষ্ঠা বিশ্বাস

 



সাপের বাচ্চা অভিশাপ
শর্মিষ্ঠা বিশ্বাস

এখানে জীবনকে নিয়ে কেউ ভাবেনা।বরং এখানে মৃত্যুকে নিয়ে সকলেই একটু বেশি মাত্রায় চিন্তিত। এরা ছোটে। ছোটার জন্য পায়ে হাঁটে। বাসে চাপে। টাঙায় চাপে। ট্রেনে ওঠে।উড়োজাহাজে ওড়ে। আধুনিক অটো রিক্সায় চাপে। উদ্দেশ্য একটাই। আর তা হলো ছুটতে ছুটতে এমন একটা জায়গায় পৌঁছানো,যেখানে পৌঁছালে মৃত্যুকে নিয়ে খুব নাড়াচাড়া করা যায়। মৃত্যুর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে খুব কাছ থেকে জীবনের পরপারকে দেখা যায়। সেইসব জায়গায় বড় বড় নেমপ্লেটের মধ্যে করে মৃত্যুর আটা মাখা হয়। তা থেকে গরম গরম রুটি পুরি, এমন কি খাস্তা পরোটাও তৈরি হয়। তারপর প্রেসক্রিপশনের পাতায় করে পকেটের বরাদ্দ বুঝে এসব মৃত্যুগুলোকে ভোজন করানো হয়।


'সে' একজন মানুষ। তার কাজ হোলো মৃত্যুকে নিয়ে যারা আটা মাখে, তাদের সাথে কর্মসুত্রে আবদ্ধ হয়ে তাদের কর্মপদ্ধতিকে লক্ষ্য করা। যেমন, রুটি বা পরোটার সাথে পরিবেশনের জন্য মশলা কষিয়ে মুরগির মাংসের মতো করে রোগীর মতো দেখতে নরম সরম মানুষের মাংস কিভাবে তার সহকর্মীরা প্রেসক্রিপশনের কাগজে করে পরিবেশন করে মানুষকেই, 'সে' তাদেরকে লক্ষ্য করে। তার দুরদৃষ্ট হৃদয়ে লুকানো থাকে একটা কালো চশমা। 'সে' সেটি চট করে চোখে পড়ে নিয়ে নিজেকে জীবন থেকে এক্কেবারে উঠিয়ে উল্টোদিকে নিয়ে মৃত্যুর সাজ সাজে। এর একটা সুবিধা এই যে, এতে করে 'সে' নামক ব্যাক্তিটি মৃত্যুর দূতাবাসের অন্যদের ভীড়ে গা ঢাকা দিয়ে থাকতে পারে।


এমনই একটি মরণের ভোজখানার নাম এক্সাম,যেখানে 'সে'এর কর্মস্থল । মহামারির সময়ে মানুষ এইরকম না দেখা বহুবিধ ব্যবস্থায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে। যেমন, অন লাইনে জীবন ও অন লাইনে মৃত্যুকে লিপিবদ্ধ করা। বর্তমানে 'সে' এক্সাম নামক মহা ভোজখানায় দূরদৃষ্টি ফেলেছে। যখনই 'সে' কোনো কিছুতে দূরদৃষ্টি ফেলে, তখন তার চোখে থাকে কালো চশমা। এতে একটা সুবিধা এই যে, চশমা জীবনের আলো ও অন্ধকারের মধ্যে পার্টিশন ওয়াল হিসেবে কাজ করে।
এইসময়ে 'সে'- কে একজন ডাকলো, এই খলিল মিয়া, এই যে আমি, আমি আপনাকে ডাকতাছি। এতক্ষণে সে-এর ভেতর থেকে খলিল মিয়া বের হয়ে মুচকি হেসে এগিয়ে গেলো সামনের দিকে, যেদিকে কুয়াশায় আপাদমস্তক ঢাকা আনন্দ মন্ডল নামের ব্যক্তিটি তাকে ডেকেছে, সেইদিকে।
চশমাটা চোখ থেকে নামাইয়া ফেলো, বললো আনন্দ মন্ডল। কিছুক্ষণের নীরবতা। এইসব নীরবতার সময় প্রকৃতির শব্দেরা ভীষণ ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে। যেমন এক্সামের সদর দরজার সামনে ঘন সবুজের আড়ালে থাকা শুকনো পাতার স্তুপের মধ্যে থেকে সরসর আওয়াজ শুনে খলিল মিয়া সেইদিকে তার মৃত্যু নামক কালো চশমাপরা চোখের দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই দেখতে পেলো শরীরে শরীরে মোচড় দিয়ে দুটো সাপ খেলছে।


বর্ষার প্রারম্ভে নিম্নচাপের প্রভাবে গতকাল খানিক বৃষ্টি হয়ে গেছে। ফলে পাতার ওপরের অংশগুলো ভিজে থাকলেও ভেতরে ভেতরে শুকনো পাতার স্তুপের মধ্যে থেকে সরসর শব্দ হচ্ছে। গ্রামবাংলার মানুষের কথায়, সাপের শঙ্খ লাগা। এসব খুব বোঝে মৃত্যুর কালো চশমাপরা চোখের দৃষ্টি নিক্ষেপ করা খলিল মিয়া। সে জানে যে, কামাতুরা হলে দুটো সাপের এমন নৃত্যরত অবস্থা কখনো কখনো দেখা যায়।


কয়েক সেকেন্ডের ভগ্নাংশ সময়ের তাল মেলাতে গিয়ে খলিল তার পকেটে রাখা ভাজ করা রুমালটা তাক করে ছুঁড়ে দিলো জোড়া সাপেদের ফনায়। সে মুরুব্বিদের মুখে শুনেছে, সাপের শঙ্খ লাগা অবস্থায় কোনো বস্ত্র ওদের ওপর ছুঁড়ে দিয়ে পরবর্তীতে সেই বস্ত্র ঘরে রাখলে ভাগ্যে চমক লাগে। জীবনের চাকা ঘুরে যায়।


এইটুকু ভগ্নাংশ সময়ের পরেই প্রকৃতির নিস্তব্ধতা খান খান করে আনন্দ মন্ডল নামে ব্যক্তি মানুষের কথা শুরু হোলো।
আরে, খলিল মিয়া, তুমি কি আমারে চিনত্যা পারতাছো না? দাওনা, আমারে, খানিকটা রুমালের টুকরা!
ফ্যাল ফ্যাল করে খানিকক্ষণ চুপ থাকলো খলিল। এই চুপ থাকাটাও মানুষের জীবনের জন্য একটা গূঢ় উপলব্ধির শক্তির যোগানদার।
এই যে সর্পযুগলের নৃত্যরত শঙ্খ লাগা অবস্থা,এ-তো যৌন আনন্দ!
পৃথিবীর সকল প্রাণীই সৃজনশীল। তাই, যৌন প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই গাছ থেকে হাঁস, মুরগী, পাখপাখালি, প্রজাপতি, মানুষ - সকলেই সৃষ্টি করতে করতে এগিয়ে চলেছে আদিঅন্তহীন কাল ধরে ধরে মৃত্যুর দিকে।
সাপ দু'টোই তাহলে আনন্দের ধারায় ভেসে গিয়ে যা সৃষ্টি করবে, তা হবে সাপের বাচ্চা!


এই যে খলিল মিয়া..
আনন্দ মন্ডল এই এক্সাম নামক মহা ভোজখানার মৃত্যু যানএর সাময়িক কালের নিয়োজিত ড্রাইভার। মনে মনে একটু চিন্তা করে খলিল আনন্দের হাত ধরে বললো, আপনারে চিনছি আমি।
আমার আজকের পোষাক আর সেদিনের পোষাক এর মধ্যে পার্থক্য আছে, আনন্দ বললো-
তাই তো বলি, খলিল মিয়া বুঝি বা আমারে চিনতে না পাইরা ব্যাবাক ভুইলা গ্যাছে!!


একেই বা বলে বুঝি, অপলকভাবে তাকিয়ে থাকা । ঠিক সেইভাবে চশমাহীন খলিল আনন্দের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে জন্ম ও মৃত্যুর মধ্যবর্তী জায়গায় চলে গেলো।


তখন মহামারি চলছে। মৃত্যুকে নিয়ে আটা মেখে গরম গরম রুটি পুরি পরোটা তৈরি হচ্ছে। উদ্বিগ্নতা এক্সাম নামক মহাভোজখানার ক্যাশ কাউন্টার থেকে সদর দরজার সামনে। অদ্ভুত আঁধারে ঢেকে আছে চারদিক। সরল অথচ নির্ভীক খলিল, বিশ্লেষক অথচ মৌনী খলিল মিয়ার কাজ ছিলো, যত মৃতদেহ আবিষ্কৃত হবে,তাদেরকে চোখের একটুখানি অংশ বাদ রেখে শীতের পাটিসাপ্টার মতন করে কাগজের পরে কাগজ, শেষে একধরনের জীবানুনাষক কাপড়ে মুড়ে রেডি করে দেওয়া। এরপরে মৃত্যু- যান গ্রাম শহরের বুক-কে সাইরেন নামক ছুরির ফলায় ফালা ফালা করে দিয়ে ছুটে যাবে একটা এক্সাম থেকে আর একটা এক্সামের দিকে।


আনন্দ মন্ডল এর মৃত্যুযানের প্রবেশ ও প্রস্থানটা বেশ আভিজাত্যপূর্ণ! সমাজের কেউকেটা গোছের লোকেদের মতন চলন। আশপাশে কেউ থাকবেনা।প্রথমে প্রবেশ।এরপর এক্সামের দরজা বন্ধ। তারপর দরজা খুললে মৃত্যু যানকে নিয়ে আনন্দের ভোঁ ভোঁ করে প্রস্থান। কখনও কখনও আনন্দের সাথে প্রয়োজনে যেতে হয়েছে খলিলকে।সেসব সংখ্যাধিক্য মৃত্যুর মহা মিছিলের মহড়ায় খলিল দেখে নিয়েছে মৃত্যুর সঠিক আদল ঠিক কীরকমের হয়। ওরা বেড়িয়ে গেলে, এরপর এক্সামের খোলা দরজার বাইরে পর্যন্ত স্যানিটেশন চলতেই থাকবে, চলতেই থাকবে..


চশমা পড়ে থাকলে মৃত্যু দর্শন, আর চশমা খোলা অবস্থায় জীবন দর্শন। এই দুটোতেই খলিল মিয়া পুরোদস্তুর এখন অভ্যস্ত। এই যেমন, এখন খলিলের চোখে চশমা নেই।সে দেখলো, আনন্দের হাতে এক্সামের কোনো একজন কয়েকটি টাকা গুঁজে দিয়ে বিরক্ত মুখে তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে ওপর তলায় উঠে গেলো। খলিল মিয়া বোঝে জীবনের মানে খেয়ে এবং খাইয়ে বেঁচেবর্তে থাকা।


এখন মহামারি কাল পার হয়ে মৃত্যু কিছুটা দূরে অবস্থান করলেও, কালা চশমায় দেখা যায়, মৃত্যু যত্রতত্রই চলছে। সামনে, পেছনে, মাথার ওপরে, পায়ের নীচে - প্রতিনিয়ত জন্ম নিচ্ছে একএকটি অদ্ভুত দর্শনের মৃত্যু। এরা সমাজে বসবাস করলেও, সামাজিক অশান্ত পৃথিবীতে বেশ পরিবেশ বান্ধব মতো দেখতে। এই সব মরণেরা লম্বা হাতওয়ালা, লম্বা জিহ্বাওয়ালা, চোখ বন্ধ করা এক একটি অতিকায় ব্যাক্টিরিয়া। এরা, লম্বা জিহ্বায় করে চেটে চেটে খায় মানুষের সুখী হওয়ার অপেক্ষায় থাকা জীবনের স্বাদ আহ্লাদকে। এরা লম্বা হাত দিয়ে স্বাভাবিক জৈবিক-বৈচিত্রে ভরপুর জীবনকে পুতুলের মতো করে নিয়ে নেড়েচেড়ে খেলে। খেলা হয়ে গেলে ছুঁড়ে ফেলে দেয় জঙ্গলের শুকনো পাতার দিকে, যেদিকে সাপের শঙ্খ লাগা অবস্থা দেখে পকেট থেকে রুমাল ছুঁড়ে দিয়েছে খানিক আগে খলিল মিয়া।
আনন্দ পিঠে হাত দিয়ে খলিলকে বললো, মিয়া ভাই, পেটটা যে আর চলে না! মহামারী পরিস্থিতি এখন কমে গেছে। আমার মৃত্যু যান এখন প্রায়ই অচল। কি যে করি! কোন পথে যাইলে সুরাহার পথ মিলবে, আমারে ক'বা মিয়া? বলতে পারবা আমারে, ফিরা আইবে তো ফের মহামারি?
খলিলের চোখে চশমা এতক্ষণে আবারও চেপে বসেছে। খলিল দেখছে, জীবন্ত খলিল আর কতগুলো মৃতের সংখ্যা নিয়ে আনন্দ মন্ডলের মৃত্যু যান এসে থামলো মহানন্দার সেই চরে, যেখানে অস্থায়ী বধ্যভূমিতে অগ্নি সংযোজিত হবে মৃত্যুর সংখ্যার ওপরে।
খুব মনে পরছে, জরুরি অবস্থার মতো মানুষের মুখ বন্ধ হয়ে গেছে। চোখ বুজে গেছে। মানুষের সুগন্ধ চুরি করে নিয়েছে জীবন্ত হয়ে থাকার কামনায় একদল বনিক।


ভীষণ অস্পষ্ট, অথচ খুবই স্পষ্ট করে চশমার ধুলোর আস্তরণের ভেতর দিয়েই খলিল দেখছে, আনন্দ মন্ডল একদিকে ড্রাইভার, অন্যদিকে দাহক। পরপর অনেকগুলো চিতা জ্বলছে। দূরে, অনেক দূরে মৃতের সংখ্যাগুলোর এক দুইজন ভগ্নপ্রায় উত্তরাধিকারী।
দাহকর আনন্দ মন্ডলের বুক পকেট থেকে খস্ করে বেড়ালের মতো মন্ত্রমুগ্ধ কাগজ বেরিয়ে পড়লো। আনন্দ দূরে দাঁড়ানো উত্তরাধিকারীকে বলছে, হ্যাঁ, আপনাকে বলছি। ইনিই আপনার বাবা। বলুন, পিতা স্বর্গ পিতা ধর্ম পিতহি পরমহং তব....
এবার দিন তো, হাজার টাকা!
হাজার হাজার হাজার টাকার ফানুশ উড়ছে আনন্দ মন্ডলদের মতো অতি সক্রিয় বহুদর্শী পকেট-দের।
এরপর?
এরপর আগুন। আগুন জ্বালিয়ে নিশ্চিহ্ন হচ্ছে একে একে মহামারী। মহামারির তুলনা কি তবে মহামার!!
তুলনা করার চেষ্টা করে করে খলিল মিয়া আকাশের দিকে তাকিয়ে আল্লাহর ভাষা বুঝবার চেষ্টা করে।
এতক্ষণে ঝাপসা হয়ে গেলো আকাশটা। আজ বুঝি বা আবারও বৃষ্টি হবে! খলিল মিয়া দেখলো, আনন্দ দুইহাতে অস্পষ্ট উচ্চারণে ঘষা কাঁচের মতো জীবন্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে এক একটা বেওয়ারিশ মৃত্যুর জন্য ওদের ধর্মের ভগবানের কাছে প্রার্থনা করছে।
কতকাল ওইভাবে ওইখানে এক্সামের সদর দরজার সামনে খলিল দাঁড়িয়ে ছিলো, মনে নাই। তবে কোনো এক বর্ষায়, মাটি যখন নবজলে অভিষিক্ত হবে, সম্বিত ফিরে আসবে খলিলের। সে দেখবে শঙ্খ লাগা সাপদের পবিত্র যৌন আনন্দ থেকে অনেকগুলো কচি কচি শিশু সাপ কিলবিল করে ঘুরে বেড়াচ্ছে এক্সামের আশেপাশে।
চশমা খুলে আবাহন করতে হবে ওদেরকে। দুধকলা দিয়ে পুষতে হবে ওদেরকে। কিন্তু, পোষ মানানোর জন্য জুতসই গুরুত্বপূর্ণ নাম দিতে হবে বাচ্চা সাপেদের। এই নাম দেওয়ার অর্থ হলো, নামেই থাকে সেই সুধার ধারাটি, যা দিয়ে যুগান্তরের পদধ্বনি শোনা যায়।


খুব ভেবেচিন্তে খলিল সাপের বাচ্চার নাম দিলো অভিশাপ।